পার্কলেন হোটেল, লন্ডন থেকে: ‘উজানে নৌকা বাওয়াই আওয়ামী লীগের কাজ’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জন্মের পর থেকেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ সব পর্যায়েই আওয়ামী লীগ উজানে নৌকা বেয়ে এসেছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
রোববার (১৪ জুন) লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া এক সংবর্ধনায় চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দেশের উন্নয়নে তার সরকারের প্রচেষ্টার কথা বলতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে আমাদের। কারণ বিএনপি’র আগের দু’সরকারই দুর্নীতি ও লুটপাট করে দেশকে বিপর্যস্ত করে রেখে গিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, আমরা ক্ষমতায় এসে যখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করি, তখন সাম্প্রতিক সময়ের মতো আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করে তারা তা বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে। এত প্রতিকূল অবস্থায়ও আমাদের সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে, এ যেন উজানে নৌকা বাওয়া। আসলে জন্মের পর থেকেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ সব পর্যায়েই আওয়ামী লীগ উজানে নৌকা বেয়ে এসেছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় সেন্ট্রাল লন্ডনের পার্কলেন হোটেলের বলরুমে অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীর এ সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের যুক্তরাজ্য সভাপতি সুলতান শরীফ।
সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুকের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এ সভায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মানপত্র পাঠ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকসহ ৫ জন ব্রিটিশ এমপিও প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অন্যান্য ব্রিটিশ এমপিরা হলেন, লেবার দলীয় এমপি ওয়েজ স্ট্রিটিং, মাইক গেইপস, জেস ফিলিপ ও কনজারভেটিভ দলীয় এমপি পল স্কালি।
ব্রিটিশ এমপিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে একেকটি ফুলের তোড়া ও বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী উপহার হিসেবে গ্রহণ করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। বক্তৃতায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, গীতা ও ত্রিপিটক পাঠের মাধ্যমে শুরু হওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা স্মরণ করে তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুর্দিনে আপনারা যেভাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক সেইভাবে আমাদের দুই বোনের দুর্দিনেও পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাই আমি যখন ব্রিটেনে আসি, তখন মনে হয় আমি আমার স্বজনদের মাঝে এসেছি।
দেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেন।
তিনি বলেন, দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, আমাদের খাদ্য এখন উদ্ধৃতও থাকছে।
দেশে এ বছর মোট ৩ কোটি ৮৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশষ্য উৎপাদন হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালকে ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল সাহায্য দিয়েছি। প্রয়োজনে আরও ১ লাখ টন পর্যন্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে আমাদের।
তার সরকারের আমলে মোট ১৩ হাজার ৭৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ৭০ ভাগ মানুষ আজ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে।
বেশি বেশি রেমিটেন্স পাঠানোর জন্যে প্রবাসীদের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের পাঠানো রেমিটেন্স আমাদের জিডিপি ৬.৫১ ভাগ এ নিয়ে আসতে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যদি আন্দোলনের নামে সহিংসতা না হতো তা হলে এটি ৭ ভাগ এ গিয়ে উঠতো।
দেশে মাথা পিছু আয় এখন ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলার এমন তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতিও আমাদের সরকার ৬.১% এ নামিয়ে এনেছে। তথ্য প্রযুক্তি উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান ৪ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ এখন ইন্টারনেটের গ্রাহক। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ২শ প্রকারের সেবা তৃণমুল পরযায়ে পৌঁছে দিচ্ছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ।
বিএনপি-জামাতের সাম্প্রতিক ‘জ্বালাও-পোড়াও’ আন্দোলনের তীব্র সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ হত্যার এমন আন্দোলন বিশ্ববাসী কখনও দেখেনি।
খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, নিজের অফিসে স্বেচ্ছাবন্দি থেকে তিনি আমার সরকারকে উৎখাত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ এখনও আমাকে টিকিয়ে রেখেছেন।
শত শত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করার জন্যে খালেদা জিয়াকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ পোড়া গন্ধেই যেন তার শান্তি। যাদের হুকুমে শত শত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই বলে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেন ।
ভারতের সাথে স্থল সীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি দীর্ঘ ৪১ বছর পর বাস্তবায়িত হচ্ছে এটি বর্তমান সরকারেরই একটি কূটনৈতিক সাফল্য।
সম্পর্ক ঠিক রেখে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রতিবেশীদের সাথে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় সেটির উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তার সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে যারা গোলামী চুক্তি বলে দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে চিৎকার করে আসছেন, তারাই এখন স্থলসীমানা চুক্তির সাম্প্রতিক বাস্তবায়নকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, এটিও কিন্তু আমাদের সফলতা।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজিব গান্ধীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হ্যান্ডশেক করতে প্রয়াত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত যখন হাত বাড়ান, তখন তিনি হাত ফিরিয়ে নেন, আর এখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে হাত মিলাতে দুই হাত আগ থেকেই বাড়িয়ে রাখেন, এই হলেন খালেদা জিয়া। বিরোধী দলে থাকলে ভারত বিরোধিতা আর সরকারে থাকলে ভারতপূজা এটিই হলো তাদের বৈশিষ্ট্য।
ভৌগলিক অবস্থানই এতদঞ্চলে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই গুরুত্ব কাজে লাগিয়েই আমরা উন্নতির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে চাই।
এ প্রসঙ্গে তিনি ভারত-নেপাল-ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তযোগাযোগ সম্পর্ক পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন আমাদের লক্ষ্য শুধু বাংলাদেশের উন্নয়নই নয়, আমাদের লক্ষ্য পুরো দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন।
দারিদ্র্যকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শত্রু উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা একসাথে লড়তে চাই।
এ সময় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্নের কথা আবারও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরা ৫ কোটি মানুষকে ইতোমধ্যে নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ততে উন্নীত করেছি। দেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে এখন মাত্র ২২ ভাগ মানুষ এমন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা শিগগিরই আসছে এমন সুসংবাদও শোনান প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায়।
সজীব ওয়াজেদ জয় তার বক্তৃতায় ব্রিটেন প্রবাসীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, টিউলিপের জন্মের আগে এই লন্ডনে খালার (শেখ রেহানা) সঙ্গে আমি তিন বছর ছিলাম। এরপরও এসেছি বার বার। আর তাই লন্ডন এলে মনে হয় নিজের আপন জায়গায় এসেছি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ তার স্বপ্ন এমন মন্তব্য করে জয় বলেন, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে তৃণমূলেও আজ ডিজিটাল সেবা পৌঁছে গেছে। আজ গ্রামে বসে সবধরনের সেবা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেরও বর্ণনা দেন জয় তার বক্তৃতায়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, আগামী ৫০ বছরে পৃথিবীর উন্নত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হবে তৃতীয়, বিশ্বসংস্থাগুলো এমনই ভবিষ্যতবাণী করছে। এই ভবিষ্যতবাণী সত্যে পরিণত করতে হলে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৪৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৫/আপডেট: ০৮৩০ ঘণ্টা
এমইউএম/এসএইচ/এমজেএফ