হোটেল হিল্টন অন পার্কলেইন, লন্ডন থেকে: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠক যাতে না হয়, সে জন্য সব চেষ্টা করেছে সরকার, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহ্রিয়ার আলম।
সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টায় কেন্দ্রীয় লন্ডনের হোটেল হিল্টন অন পার্কলেইনে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত এক আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এ অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ফলপ্রসূ করতেই আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো ব্যস্ত ছিল। এ সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হবে কি হবে না, এমন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না আমাদের।
তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে তিনি কার সঙ্গে বৈঠক করবেন, এটি একান্তই তার নিজ সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এখানে আমাদের সরকারের করণীয় কিছু নেই।
শাহ্রিয়ার আলম খালেদা জিয়ার এমন ‘মিথ্যা’ অভিযোগে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, নিজের রাজনৈতিক ও দলীয় ব্যর্থতা ঢাকতেই সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী এমন আজগুবি অভিযোগ উত্থাপন করছেন।
দীর্ঘ ৪১ বছর পর ৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পেরে নিজে গর্বিত জানিয়ে তরুণ প্রজন্মের এই রাজনীতিক বাংলানিউজকে বলেন, ভারতের কিংবদন্তী রাজনীতিক ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের জাতির জনকের করে যাওয়া একটি চুক্তি দীর্ঘ ৪১ বছর পর হলেও কার্যকর হয়েছে, এতে আমরা সন্তুষ্ট।
তিনি বলেন, এটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছে। আমাদের সরকারের অন্যতম একটি বড় কূটনৈতিক সফলতাও এটি। এমন একটি ঐতিহাসিক কার্যক্রমে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পেরেছি। এটি আমার জন্যও অন্যতম একটি পরম পাওয়া।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরার এই ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনার সময় ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্যদের মধ্যে যে আবেগ আমরা দেখেছি, সেই আবেগই বলে দেয়, ভারত-বাংলাদেশের পারষ্পরিক সম্পর্ক কত গভীর!
ভারতীয় পক্ষের আন্তরিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি নিজে টেলিভিশনের লাইভ প্রোগ্রামে দেখেছি, বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে গিয়ে রাজ্যসভার প্রবীণ সদস্যরা কীভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন! বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে ভারতসহ পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের মনে বিশ্বনেতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, ভারতীয় রাজ্যসভায় প্রবীণ সদস্যদের আবেগপ্রবণ স্মরণ বক্তৃতাই তার প্রমাণ দেয়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে প্রতিটি দেশেই অভ্যন্তরীণ ইস্যু থাকে। তবে জাতীয় স্বার্থে এক সময় এই ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আর দ্বিমত থাকে না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, জাতীয় স্বার্থের চেয়ে এখানে আমরা দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থে প্রভাবিত হয়ে যাই।
বিএনপির অন্ধ ভারত বিরোধিতার কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় গেলে ভারত তোষণ ও বিরোধী দলে গেলে অন্ধ ভারত বিরোধিতা বিএনপির রাজনৈতিক কালচার। তবে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করার তাদের এই অপচেষ্টা আর দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলেই আমার ধারণা।
শাহরিয়ার আলমের মতে, দেশের ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন তরুণ। তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান যুগে এই তরুণ জনগোষ্ঠীর চোখকান খোলা। বিএনপির মধ্যেও এই তরুণদের একটি অংশ আছে।
তিনি মনে করেন, অবাস্তব ও দেশের স্বার্থে ক্ষতিকর রাজনৈতিক কৌশল বিএনপির এই তরুণ অংশ মেনে নিচ্ছে না।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভারত বিরোধিতায় নিজেকে আপসহীন প্রমাণ করতে গিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ করতে না যাওয়া যে কতটুকু রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, এটি বিএনপি নিজেই বুঝতে পারছে। আর এ কারণেই মোদি দর্শনে তাদের এত বিরামহীন প্রচেষ্টা ছিল।
শাহরিয়ার আলম বলেন, আপনি সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করবেন, দেশের কোনো উচ্চ পদে মুসলমান ছাড়া আর কোনো ধর্মবিশ্বাসীকে গ্রহণ করবেন না। ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চাইবেন, জঙ্গিবাদ উস্কে দিয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অশান্ত করবেন, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী জঙ্গিদের নেতৃত্বদানকারী সংগঠনকে নিয়ে রাজনীতি করবেন, পাশাপাশি প্রতিবেশী আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দহরম মহরম করার ইচ্ছে পোষণ করবেন, আধুনিক রাজনীতিতে এটি তো হয় না।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মতে, এই ইস্যুতেই এখন বিএনপি ডিভাইডেড (দ্বিধাবিভক্ত)। আর এই ডিভাইডেড অবস্থার কারণেই মোদি দর্শন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার ভারতপ্রেম, আবার এখন ‘দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বন্ধুপ্রতীম সম্পর্ক হয়না’ এমন মন্তব্য।
এটি বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
তিস্তা চুক্তিসহ অন্যান্য বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, সব সমস্যারই সমাধান হবে।
তার মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলে ভারতসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সব ইস্যুরই শান্তিপূর্ণ সমাধান এরই মধ্যে সম্ভব ছিল।
এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকালীন সময়ে পার্বত্য চুক্তি ও গঙ্গার পানি চুক্তির কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে হারানো না হলে ভারতের সঙ্গে সব সমস্যারই সমাধান ইতোমধ্যে হয়ে যেতো।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, সেটির প্রথম অধ্যায় ছিল গঙ্গাচুক্তি। এরপর পার্বত্য চুক্তি করে দীর্ঘদিন ধরে অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন শান্তি।
শাহরিয়ার আলমের মতে, ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট অন্যান্য সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রক্রিয়া চলাকালীনই ২০০১ সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে হারানো হয় আওয়ামী লীগকে।
পরবর্তী বিএনপি শাসনামলে এই প্রক্রিয়া আর এগিয়ে নেওয়া হয়নি এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, দিল্লিতে গিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেও বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলতে তখন ভুলে যেতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে আলোচনা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে দুই দেশের পারষ্পরিক আলোচনা আমরা অব্যাহত রাখি। আর এর সর্বশেষ ফলই হলো- স্থলসীমান্ত চুক্তি। সুতরাং তিস্তাসহ সব সমস্যার সমাধানই সম্ভব, যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়।
আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আরো সুদৃঢ়।
জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সরকারের দৃঢ় ভূমিকা ওয়াশিংটনের কাছে খুবই প্রশংসিত বলে মন্তব্য করেন শাহ্রিয়ার আলম।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিচার ব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ড আমেরিকায় আছে। এক্ষেত্রে এই বিচার নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি তো নেইই; বরঞ্চ ৭১-এর মানবতাবিরোধীদের বিচারের পক্ষেই তাদের দৃঢ় অবস্থান। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেহেতু মৃত্যুদণ্ডেরর বিধান নেই, সেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আদালতের রায় মৃত্যুদণ্ড হলে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের নীতিগত অবস্থানটিই শুধু তারা একটি চিঠিতে স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের বুঝতে হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই অবস্থান শুধুই মৃত্যুদণ্ডবিরোধী নীতিগত অবস্থান। এটি বিচারবিরোধী অবস্থান নয়।
সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের শক্ত ভূমিকার পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে রেজুলেশন করে জামায়াত-শিবিরের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
দেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্র্রীর নেতৃত্বে যে সমষ্টিগত উন্নয়ন হয়েছে, তা নজিরবিহীন। মাত্র ৫ বছরে দারিদ্র্যসীমা ২২ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনার সরকার; ২০২১ সালের মধ্যে যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।
এ প্রসঙ্গে তিনি মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলার এবং জিডিপি ৬.৫১ শতাংশে উন্নীত করা এবং মূল্যস্ফীতি ৬.১ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৫২৪ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
এবি