কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া থেকে: সপ্রতিভ, আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা। এই বিদেশ-বিভূঁইয়েও তাকে দেখে ঠিক এমনতরো বিশেষণগুলোই ভিড় করলো মাথার ভেতর।
তাকে দেখতে কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি ছুটে এসেছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কুয়ালালামপুরে পুত্রা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার তাই এক টুকরো বগুড়াই হয়ে উঠেছে যেন। বগুড়ার মানুষ যেমন তারেককে ভালোবাসে, নিজের ঘরের ছেলে মনে করে, তার কথা বলতে ও শুনতে পছন্দ করে, ঠিক সেই আবহই ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সেন্টার জুড়ে।
প্রতিটি মানুষের সঙ্গেই হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন জিয়াপুত্র। চোখেমুখে যেন খেলছে তৃপ্তির ছটা।
স্থানীয় বিএনপির উদ্যোগেই বুধবারের সন্ধ্যার এ আয়োজন। সভায় প্রধান অতিথি তারেক।
কালচে ছাই রঙা স্যুট ও সাদা শার্ট পরিহিত তারেক সারাক্ষণই যেন সতেজ। নড়াচড়া আর ভঙ্গীতে কোন কিছুতেই হার না মানার প্রত্যয়।
হল রুমের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর উচ্ছ্বল উন্মাদনায় সায় দিচ্ছেন মাথা নেড়ে। কখনো দুই বা তিনটি আঙুল মুখের ওপর দিয়ে আরও মনোযোগে উপভোগ করছেন নেতাকর্মীদের আনন্দ।
এই প্রবাসেও এমন উপচানো ভিড় দেখেই হয়তো খুশি খালেদা পুত্র। প্রত্যয়ী চোখে সে খুশির ঝিলিক।
শনি বা রোববারের ছুটি নয়, বুধবারের কর্মদিবসেও দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো নেতাকর্মী এসেছেন শুধু তারেক রহমানের কথা শুনতে।
র্যাব বিলুপ্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন তারেক। কিন্তু বিষয়বস্তুর চেয়ে উদ্বোধকের প্রতিই সবার আগ্রহ বেশি।
দেওয়ান তুন রাজ্জাক হল-বি’তে লোক সমাগম ক্রমেই বাড়ছিল। পৌনে আটটায় সেন্টারের সীমায় উপস্থিত হন তারেক। সেই খবরেই কণ্ঠের সব শক্তি এক করে স্লোগান চড়াতে থাকেন সমবেত নেতাকর্মীরা।
আটটার দিকে মঞ্চে ওঠেন তিনি। সবার উচ্ছ্বাসের জবাবে হাত নাড়েন। নেতাকর্মীদের চোখের ভাষা যেন পড়তে পারছিলেন সহজাত মুন্সিয়ানায়। হাসিমুখে তাকালেন সবার দিকে।
কালো পোশাক পরিহিত বেশ ক’জন মালয় যুবক রয়েছেন তারেকের নিরাপত্তায়। কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না তারা।
মঞ্চে উঠে বসার আগে নেতাকর্মীদের দিকে এগিয়ে আসেন তারেক। হাত মেলান, কুশল বিনিময় করেন। নেতাকর্মীদের আবেগ তখন যেন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে।
একটি ছোট্ট শিশু তারেককে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালো। আলতো করে তার গাল টিপে নাম জানতে চাইলেন তারেক। শিশুটি বেজায় খুশি মনে মঞ্চ ছাড়লো।
যারাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন সবার নাম জানলেন, কুশল বিনিময় করলেন তিনি। কখনো পিঠ চাপড়ে বাহবা দিলেন।
কোরআন তেলাওয়াত ও সবার কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত, এরপর দলীয় সঙ্গীত। শুরু হল মালয়েশিয়া বিএনপির নেতাদের বক্তব্য।
নিজের গ্লাসটি নিজেই টিস্যু দিয়ে মুছলেন, পানি ঢেলে নিলেন। মাঝে মাঝে সামনের কাগজে টুকটাক নোট নিচ্ছিলেন তিনি। নেতারা বক্তব্য রাখছিলেন, বক্তব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা নেড়ে ভাব আর হাসি বিনিময় করছিলেন তারেক।
‘একজন নেতাকে অবশ্যই একজন ভালো শ্রোতা হতে হয়’- এই নীতিটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিলেন তিনি।
হলের ভেতরে নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক পাচ্ছিলাম না। অনুষ্ঠানের আপডেট সারাক্ষণ একটু একটু করে অফিসে পাঠাচ্ছিলাম। তাও যেতে অনেক সময় নিচ্ছিল।
আমার সহকর্মী মাজেদুল নয়ন স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে বললেন, মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশতো কম দূর না, একটু সময়তো লাগবেই!
তার কথায় না হেসে পারলাম না। টানটান টেনশনেও ফুরফুরে মেজাজ। মাথা ঠাণ্ডা রেখে হাসি-কৌতুকে ভালো কাজ করার গুণ রয়েছে নয়নের।
বক্তব্য, অনুষ্ঠানের টুকিটাকি নোট নেওয়া, ছবি তোলা সবই তিনি নির্বিঘ্নে করছিলেন।
ল্যাপটপে নোট নিচ্ছিলাম, মোবাইলে বক্তব্য রেকর্ড করছি, তিনি ছবি তুলছেন। ফোনে অফিসে খবর ও ছবি সরবরাহ করছি। সব মিলিয়ে মহাব্যস্ত দু’জনে!
এমন সময় মঞ্চ থেকে ডাক এলো। বাংলাদেশ থেকে আসা বাংলানিউজের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলবেন তারেক।
একটু অবাক হলেও এগিয়ে যাই। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মালয় যুবকরা এগিয়ে আসে। তাদের বাধা সরিয়ে মিয়া নাসিরুদ্দিন অপু(তারেকের এক সময়কার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা) মঞ্চে নিয়ে যান আমাকে।
আমি কথা বলার আগেই তারেক স্মিত হেসে কথা বলেন। বাংলাদেশ থেকে এতদূরে আসা একজন সাংবাদিক দেখে তারেকের মুখে আন্তরিকতার হাসি। বয়সে ছোট আমাকে দেখেই হয়তো গলায় স্নেহের সুরও পাওয়া গেলো।
এরপর টুকটাক কথা হলো। কথাতে ষোলোআনা মুন্সিয়ানা। উত্তর দিচ্ছিলেন শান্তভাবে। আবার পাল্টা প্রশ্নে জানতেও চাইলেন কিছু বিষয়ে।
তার কন্ঠে অকৃত্রিম আন্তরিকতার ছোঁয়া টের পেলাম। দেশের প্রতি মমত্ববোধ অটুট।
এটাই হয়তো বাংলাদেশের যাদু। যে যত দূরেই থাকুক, দেশের প্রতি, এদেশের মানুষের প্রতি মমতা কমে না, বরং বাড়ে।
দেশ নিয়ে তারেকের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল কথায়, আচরণে। এক পর্যায়ে বললেন, প্রবাসীরাতো তাও চাইলেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন!- এই কথায় হয়তো নিজের কষ্ট বোঝানোর চেষ্টাই করলেন তিনি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বক্তব্য রাখছিলেন তখন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে সিনিয়র এ নেতা হয়তো ভুল ক্রমেই বলে বসেন, তারেকের বয়স কতো হবে, ৫৩।
সঙ্গে সঙ্গে বেশ হাসিমুখেই হাত নেড়ে তারেক বললেন, ‘আরে না, আরে না। ’ মোয়াজ্জেম হোসেনের ভুল তথ্যকে হাসি দিয়ে ঢেকে দিলেন তিনি। তৈরি হলো নিখাদ হাস্যরসের উপলক্ষ্য।
এর মধ্যেই আরেক শিশু এসে উঠলো মঞ্চে। বয়স ৫ কি ৬ হবে। তারেক ছবি তোলার জন্যে হাসি দিলেন। এরপর কাছে টেনে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
তারেকের বক্তব্যে তার পিতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বক্তব্যের ছায়া।
বক্তব্যের শুরুতে জিয়ার মতোই দু’হাত উঠিয়ে বলেন, ‘সবাইকে শুনতে হবে। সবাই বললে, শুনবে কে!’ মুহূর্তের মধ্যে সমর্থকরা শ্লোগান বন্ধ রেখে চুপ হয়ে মেরে গেলেনে যেনো।
বক্তব্যের সময় আশপাশের সমর্থকদের মোহিত করার ক্ষমতা রয়েছে তারেকের। সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি কি ঘটেছিল?’
সভার ডান পাশ থেকে এক সমর্থক বললেন, ‘বাকশাল’। তারেক খুজঁলেন লোকটিকে। ‘কে বললেন? হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। ’ এভাবেই তারেকের সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছিল পুরো সভা।
তারেকের প্রতি মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসীদের আবেগ দেখছিলাম ক’দিন ধরেই। মালয়েশিয়া আসার পর থেকে যাদের সঙ্গেই দেখা হচ্ছিল, বেশিরভাগ মানুষ তারেককে নিয়ে অনেক বেশি কথা বলছিলেন।
এর আগে তারেক রহমানের গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় যাওয়া হয়েছিল বাংলানিউজের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্টে।
সেখানে দেখেছিলাম, সবাই তারেককে নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। তাকে নিজের ঘরের ছেলে মনে করেন। জিয়া পরিবারের জন্য তাদের আবেগ সীমাহীন।
নয়নকে বললাম, এই মালয়েশিয়ায় সেই বগুড়ার চিত্রই দেখছি।
তারেকের শারীরিক অবস্থা, বিএনপিতে তার প্রয়োজনীয়তা, দেশের রাজনীতিতে তার বিকল্পহীনতা, তার প্রতি কার কত ভালোবাসা সেসব ফিরিস্তিই শুনছিলাম প্রতিদিন কারও না কারও বয়ানে।
বুধবারের এই সভায় তারেক তাই সহজেই উজ্জ্বীবিত করতে পারছিলেন নেতাকর্মীদের।
চলতি মাসের ২ তারিখ সোমবার তিনি মালয়েশিয়ায় আসেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৮ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৪