লাঙ্কাউই, মালয়েশিয়া থেকে: ‘এয়ার এশিয়া’র জানালায় তখন আর মেঘ নেই। বিকেলের পরিষ্কার আকাশের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটি দ্বীপ, চারপাশে তার নীল সমুদ্র।
মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই বিমান ল্যান্ড করে লাঙ্কাউই এয়ারপোর্টে পৌঁছুলাম। তখন সন্ধ্যা সাতটা। এখানে অন্ধকার হয়নি এখনো পুরোপুরি। সময় বাঁচাতে কুয়ালালামপুর থেকে লাঙ্কাউই বিমানেই আসতে হয়েছে। খরচ বেশি পড়লেও এখানে ডমেস্টিক এয়ারে যাতায়াত বেশ সুখকর। আসা যাওয়ায় খরচ পড়বে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো।
এছাড়া বাসেও ভালোভাবে আসা যায়। প্রতিজনের আসা-যাওয়ায় খরচ পড়বে তিন হাজারের কিছু বেশি। দলে মানুষ বেশি হলে বাস জার্নিটাই বেশি উপভোগ্য বলে সবার কাছে জেনেছি।
লাঙ্কউই এয়ারপোর্টটা ছিমছাম, কোন চেক-আউট নেই। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো ক্ষুধায়। রানওয়ে থেকেই সোজা চলে গেলাম দোতলার রেস্তোরাঁয়। মালয় তরুণ-তরুণী টুনা মাছের স্যান্ডউইচ খেতে দিলেন।
মালয় ম্যানেজারের পরামর্শ, এখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চেনাং বিচ চলে যান। সেখানে দেখে শুনে হোটেল ঠিক করতে পারবেন, বাজেট হোটেল রয়েছে কিছু।
এয়ারপোর্টের ট্যাক্সি রিজারভেশন থেকে দুইজনের জন্যে চেনাং যাওয়ার ভাড়া ২০ রিঙ্গিত। অবশ্য চারজনেরও একই ভাড়া। লোক বেশি হলে ভাড়াও বাড়বে।
মধ্যবয়স্কা মালয় নারী হাতে ধরিয়ে দিলেন লাঙ্কাউই’র দর্শনীয় স্থানের ছবিসহ একটি ম্যাপ। আধঘন্টা মাত্র সময় লাগলো চেনাং আসতে।
ঘুরে ঘুরে হোটেল খুঁজে বের করলাম। এখানে ৭০ থেকে শুরু করে ২ হাজার রিঙ্গিতের সিঙ্গেল রুম দেখলাম। যার যার বাজেট অনুযায়ী নেওয়ার সুযোগতো রয়েছেই। তবে হোটেলে ওঠার আগে রুমের সব সুযোগ সুবিধা অবশ্যই চেক করে নিতে হবে।
বিচের পাশ ঘেঁষে রয়েছে অনেক মোটেল আর কেবিন। বিকেলের মধ্যে যেতে পারলে এটা খুঁজে নেওয়া বেশি সহজ।
রাতেই ম্যাপ দেখে আমরা পরদিন কোথায় যাব তা ঠিক করে নিলাম। কারণ হাতে সময় মাত্র কয়েকঘন্টা। কুয়ালালামপুর ফেরার ফ্লাইট পরদিন সন্ধ্যায়।
আমাদের হোটেলের পাশেই ছিল আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড আর পেঙ্গুইন ওয়াচ। তাই প্রথমেই সেখানে। প্রতিজনের প্রবেশ মূল্য ৪০ রিঙ্গিত করে। প্রথমেই রেইন ফরেস্ট, সেখানে রয়েছে হরেক রকমের ছোট পশু পাখি। আর রয়েছে বড় বড় অ্যাকুরিয়ামে হরেক রকমের মাছ। পাশেই সেগুলোর নাম পরিচয় লেখা, সঙ্গে নির্দেশনা- ক্যামেরায় ফ্লাশ ব্যবহার করা যাবে না।
অনেকটা জঙ্গলের আদলে বানানো হয়েছে এটি। বকগুলো নিজের মতো দাঁড়িয়ে পানিতে, ম্যাকাও মাঝে মাঝে চিৎকারে চূর্ণ করছে বনের নিস্তব্ধতা।
এরপরেই মাছের জগৎ। সাগরের নিচের বৈচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মাছগুলোকে দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যাবে। ভেতরে রয়েছে কৃত্রিম ঝর্ণা। ‘কোট পরা ভদ্রলোক’ নামে পরিচিত পেঙ্গুইনদের চলাফেরা দেখতে বেশ লাগে। ছোট ছোট পায়ের ওপর ওদের শরীরটাকে বেশ ভারী লাগছিল।
অন্যদিকে অনেকগুলো হাঙর ঘুরে বেড়াচ্ছে বীর দর্পে।
এখানে আর বেশি সময় না দিয়ে বের হয়ে গেলাম।
লাঙ্কাউই বিচ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিচগুলোর একটি। এর নীলাভ পানিতে সত্যিই মন ভরে গেল। এখানে রয়েছে প্যারাগ্লাইড, স্কুবা-ড্রাইঢিং-এর সুযোগ। ৯০ থেকে ১৫০ রিঙ্গিতে উপভোগ করা যায় এসব ড্রাইভ।
এছাড়া বিচে শুয়ে সূর্যস্নানটাও মন্দ লাগবে না। সাদা চামড়ার পর্যটকরা চোখে সানগ্লাস দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে গোসল করছেন। গায়ের রঙে বাদামী রং আনতে চাচ্ছেন অনেকে।
চারপাশে হরেক রকমের পানীয়র সুব্যবস্থাতো রয়েছেই।
আন্ডারওয়াটার ওয়াল্ডের পাশেই রয়েছে ডিউটি ফ্রি শপ। এখান থেকে ট্যুরিস্টরা ট্যাক্স ফ্রি জিনিসপত্র কিনতে পারবেন। যেটার কুয়ালালামপুর বা অন্য কোথাও দাম হয়ে যাবে কয়েকগুণ বেশি।
টুকটাক কেনাকাটা শেষে ট্যাক্সি নিয়ে ক্যাবল কার-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। দূর থেকেই চোখে পড়ে লাঙ্কাউই পাহাড়ের চূড়া মেঘের ওপরে উঠে গেছে। চূড়ার দেখা পাওয়া সম্ভব নয় পাতাল থেকে।
ট্যুরিস্টদের জন্যে ৩০ রিঙ্গিত করে ক্যাবল কারে ওঠার খরচ। চলতে শুরু করলো ক্যাবল কার। প্রথমে ধীরে ধীরে, এরপর কিছুটা গতি নিয়ে চলা শুরু হলো। ১০ মিনিট পরে পাহাড়ের একটি চূড়ায় কিছুক্ষণের বিরতি। উপরেই নামাজ, ঠাণ্ডা পানি পানের সুযোগ রয়েছে, ওয়াশরুমের ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত।
সেখানে নামার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়। তবে সেই প্রিন্ট করা ছবি যখন আপনার হাতে ধরিয়ে ২০ রিঙ্গিত চাওয়া হবে, তখন ছবিটা নিতে নাও ইচ্ছে করতে পারে। আর না নিলেও ওরা যে খুব রাগ করবে, তাও নয়। মিষ্টি হাসি দিয়ে বলতে পারবেন, লাগবে না।
দেখতে দেখতে মেঘের ওপরে উঠে যায় ক্যাবল কার। উপরে উঠে সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত।
মেঘে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে মাঝে মাঝে। মেঘের মধ্যে ডুবে থাকার অনুভূতি অনেক শীতল, উপভোগ্যতো অবশ্যই।
এরপরই এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা। কিছুটা আক্ষেপ থাকলো, আরও বেশি সময় নিয়ে এলে আরও কিছু জায়গা দেখা যেত।
কারণ এখানেই রয়েছে ঈগল পয়েন্ট, গুনুং রায়া মাউন্টেন, ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক, ব্ল্যাক স্যান্ড বিচ, লিজেন্ডা পার্ক, সেভেন ওয়েলস ওয়াটার ফল, বাঁদুরের গুহাসহ কিছু পর্যটন এলাকা।
পর্যটন এলাকায় থাকা-খাওয়ার একটু বেশি খরচ পড়াটাই স্বাভাবিক। তবে প্রিয়জনরা অনেকে একসঙ্গে গেলে খরচটা কমে আসবে।
যেকোনো সহযোগিতা এয়ারপোর্ট, হোটেল মালিকসহ যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই পাওয়া যায়। এখানে পর্যটকদের উপযোগী পরিবেশ ও আচরণে সবাই বেশ আন্তরিক।
বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘন্টা, জুন ২০, ২০১৪