সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে: প্রবাসে বেশ সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে চলছেন বাংলাদেশিরা। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে মালয়, চায়নিজ এবং ভারতীয়দের পরই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অবস্থান।
সিঙ্গাপুর সরকার, ব্যবসায়িক সমাজ এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির লক্ষে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স সিঙ্গাপুর, সংক্ষেপে বিডি চেম্বার সিঙ্গাপুর। গত ১৩ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ডেস্কার রোড এলাকায় বাংলানিউজের সঙ্গে সংগঠনের কার্যক্রম, উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেন বিডি চেম্বারের সহ-সভাপতি মির্জা গোলাম সবুর, আব্দুল কাদের এবং যুগ্ন সম্পাদক নাসিরুল ইসলাম মনি।
আব্দুল কাদের বলেন, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বার অব সিঙ্গাপুর গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখানে গেজেট আকারে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয় ২০১০ সালে। সিঙ্গাপুর সরকারের অনুমোদন নিয়ে মাত্র ৩৪ জন সদস্য নিয়ে এ চেম্বার যাত্রা শুরু করে। এই চেম্বার বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী গ্রুপ ছাড়াও সিঙ্গাপুরে ব্যবসারত অন্যান্য দেশের ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর সঙ্গেও সর্ম্পক রক্ষা করে।
তিনি বলেন, চেম্বার ব্যবসায়িক বিনিময় ও সুবিধা প্রদানের জন্যে আলোচনা করে। বর্তমানে ১০৩ জন সদস্য রয়েছেন এ চেম্বারে। প্রতি মাসে ২ জন, চারজন করে সদস্য বাড়ছে। প্রতি দু’বছর অন্তর চেম্বারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে দ্বিতীয়বারের মতো কেউ প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি নির্বাচিত হতে পারবে না।
আব্দুল কাদের জানান, বর্তমানে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি মালিকানায় ১১০টির ওপর মিনি মার্কেট রয়েছে। ৪০টি ক্যাটারিং সার্ভিস রয়েছে। গার্মেন্টস পণ্য বিক্রি হচ্ছে ৩০ টি দোকানে। এই হলো বিডি চেম্বারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
বিডি চেম্বার গড়ে ওঠার পেছনের কথা জানান মির্জা গোলাম সবুর। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা এখানে যার যার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিলাম। কারো কনস্ট্রাকসন ব্যবসা, কারো ট্রাভেল, কারো এন্টারপ্রাইজ, কারো গার্মেন্টস। তবে আমাদের কোনো প্লাটফর্ম ছিলো না। আমরা নিজেরা ভাবলাম, যদি এ সরকারের কাছে কোন দাবি আদায়ের জন্যে যেতে হয়, তবে তার জন্যে তো একটা প্লাটফর্ম দরকার। একা গিয়ে কথা বলার চেয়ে সংগঠনের পরিচয়ে কথা বলার সুবিধা রয়েছে এবং মূল্যায়ন করে তারা।
সবুর বলেন, একটা অনুষ্ঠান করতে হলেওতো সংগঠনের প্রয়োজন হয়। সংগঠন হওয়ার পর অনুষ্ঠানের অযুহাতে একজন মিনিস্টারকে ডাকতে পারি। তার সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার ফাকেঁইতো একটা সমস্যার কথা উঠাতে পারি। এগুলো একটা চ্যানেল। যাত্রাটা ভাল হয়েছে। তৎকালীন রাষ্ট্রদূত কামরুল হাসান পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন সে সময়। বিডি চেম্বারের পক্ষ থেকে বাঙালিদের বলি নজরটাকে বড় রাখতে।
সবুর বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের বলেছি, ভাই আপনি ভাল আছেন, মার্সিডিজ চালান, কিন্তু কমিউনিটির জন্যে কি করছেন? দেশের জন্যে এগিয়ে আসেন।
নাসিরুল ইসলাম মনি বলেন, দেখা যাচ্ছে একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মাসে এক লক্ষ ডলারের মাল কিনছেন চায়নিজ থেকে। সে পণ্য যদি বাঙালি সরবরাহ করে, তবে কিনতে সমস্যা কি! সেটার সমাধান করতে হবে। নিজেদের মধ্যে একটা বাণিজ্য চালু করার বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে।
সবুর বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা এখানে বিনিয়োগ করতে চায়, তাদেরকেও সাহায্য করে বিডি চেম্বার। অনেক সময় মালয় বা চায়নিজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ব্যবসা করতে গিয়ে সব খোয়াতে হচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভিন্ন জাতিগুলোর পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব আরো মজবুত করার।
মনি বলেন, সিঙ্গাপুরকে বলা হচ্ছে বর্তমানে বিজনেস হাব। সারা পৃথিবীর ব্যবসায়ীরা এখানে আসছেন। সিঙ্গাপুরের বাজারকে পৃথিবীর বাজার বলা হচ্ছে। এখানে পণ্য প্রদর্শন করলে, পুরো পৃথিবীতে প্রদর্শন করা হয়। এই বাজারে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আরো দৃঢ় অবস্থান তৈরি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এখানকার ব্যবসায়ীরাও স্বদেশকে তুলে ধরতে পারেন সিঙ্গাপুরে।
তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে ব্যবসার পরিবেশ বেশ ভাল। বিনিয়োগও নিরাপদ। তবে সে ক্ষেত্রে ভাল করে খোঁজ খবর নিতে হবে। সরকারের নিয়মগুলো জেনে রাখতে হবে। তা না হলে কিন্তু বিপদে পড়তে হয়। পূর্বে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়িক ভুল খাতে বিনিয়োগ করে, সর্বস্ব খুইয়েছেন।
মনি বলেন, সিঙ্গাপুর একটি নিরাপদ দেশ। এখানে কেউ অপরাধ করে পার পায় না। তাই ব্যবসার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতার বিষয়টি রয়েছে। এখানে মানুষ ঠকিয়ে ব্যবসা করতে চাইলে হবে না। পণ্যের মান ঠিক রাখতে হবে। এখানকার সরকার অবশ্যই দেখতে চাইবে, তাদের নিজেদের লাভটিও। তাই সকল দিক বিবেচনা করে, বাজার যাচাই করেই ব্যবসায় নামতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সাফল্যের কারণেই এখন কমিউনিটির লোকজন মোস্তফার সামনের এ এলাকাটাকেই বাংলাদেশি এলাকা তৈরি করেছি। এখানে আমাদের ব্যবসায়ীদের দিয়েই বাণিজ্য শুরু হয়।
বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরে রয়েছেন, অনেক বড় কোম্পানির অফিস রয়েছে সিঙ্গাপুরে। তারাও সংযুক্ত হয়েছেন বিডি চেম্বারে, জানান মিনু।
সবুর বলেন, ১৯৭০ এর দিকেও কিন্তু এখানে দু’একজন ব্যবসায়ী ছিল। তবে মূলধারার ব্যবসা শুরু হয় ১৯৯০ এর পর থেকে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সালের সময়টায় এ এলাকায় ৭০ শতাংশ দোকান বাঙালির। গত চার বছরে এটা দ্বিগুণ হয়েছে। সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তোয়াজে গেলেও বাঙালি দোকান দেখা যাবে, উডল্যান্ডে গেলেও পাওয়া যাবে।
৭ দিনের ২৪ ঘণ্টাই কিন্তু এখানে দোকান খোলা থাকছে। আমরা বলি, এর মধ্যেও ব্যবসাটাকেও বাড়াতে হবে। এখানে ১ লক্ষ বাঙালি রয়েছে। এ কমিউনিটির ওপর টার্গেট করেও ব্যবসা সম্ভব।
এখানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সাহায্য করার বিষয়ে বিডি চেম্বারের কার্যক্রম সর্ম্পকে মনি বলেন, বাংলাদেশি ব্যবসায়ী হয়তো একটা টেন্ডার নেবেন। কিন্তু তখন তাকে চেম্বারের আওতায় আসতে হয়। তখন সরকার সেই ব্যবসায়ীকে মূল্যায়ন করে।
এছাড়াও সিওও (সার্টিফিকেট অব অরিজিন) এর জন্যে কোনো না কোনো চেম্বারের কাছে যেতেই হয় ব্যবসায়ীদের। তখন অন্য জাতির চেম্বার হলে কয়েক সপ্তাহ ঘোরায়। কিন্তু আমরা ২৪ ঘণ্টা থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে এটা ব্যবস্থা করে দেই।
চেম্বারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কিভাবে উপকৃত হতে পারে? জানতে চাইলে সবুর বলেন, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পণ্যটাকে এখানে প্রদর্শন করা যাবে। কারণ এখানে ১০ লক্ষ পর্যটক ও ব্যবসায়ী একই সময়ে রয়েছেন। এখানে বিশ্ববাজারে ঢোকা যায়। আমরা একটা বাংলাদেশি ট্রেড ফেয়ার করলে, সারা বিশ্বের ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা বাংলাদেশের পণ্য সর্ম্পকে জানবে।
এতো বহিরাগত ব্যবসায়ীদের আনাগোনা রয়েছে বলেই, সিঙ্গাপুরে সাধারণ মানের হোটেলের ভাড়া ১০০ থেকে দেড়শ’ ডলার। তারা ট্যাক্সি ভাড়া করছে। বছরে ট্যুরিজম থেকে আশি থেকে নব্বই লক্ষ ডলার আয় করে এ দেশ।
তিনি বলেন, এখানে আইটি, কলসেন্টার, ডাটা এন্ট্রির সার্ভিস রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন দক্ষতা এখানে প্রদর্শন করার সুযোগ রয়েছে। এখানে এসব সার্ভিস সেক্টর ভারতীয় আর ফিলিপাইনিদের দখলে। আমাদের টার্গেট রয়েছে এ ধরনের মেলা আয়োজনের।
চেম্বারের মেম্বার হওয়ার যোগ্যতা সর্ম্পকে তারা জানান, প্রথমত বাংলাদেশি হতে হবে। আবার বাংলাদেশি অরিজিন সিঙ্গাপুরিয়ান হলে সে ক্ষেত্রে হাইকমিশন থেকে সার্টিফিকেটে নিতে হবে। কারণ না হলে কিছু পাকিস্তানি ও ভারতীয় রয়েছে যারা হয়তো মাইগ্রেট করে পাকিস্তান বা ভারতে চলে গেছে। এগুলোকে ফিল্টার করতে হয়।
সংগঠনের সংবিধানমতে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত অটোমেটিকালি চিফ পেট্রোন। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। পরামর্শ-উপদেশ দেন।
মনি বলেন, সিঙ্গাপুর সবসময়ই সিঙ্গেল কান্ট্রি ট্রেড ফেয়ার। এখানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্যে আমাদের চেম্বার ইনফোরমেশন সেন্টার হিসেবে কাজ করে। এখানে আমাদের মেম্বারদের ডাইরেক্টরি রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সেটি দেখাই। অনেকে পরিচিত ব্যবসায়ী খুঁজে পান।
তিনি জানান, এখানে এমন ঘটনা রয়েছে- চায়নিজ বা মালয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কোম্পানি খোলার পর তারা লক্ষ ডলার নিয়ে কেটে পড়েছেন। জাহাজ কিনে ২২০ কোটি টাকা গচ্ছা দিয়ে চলে গেছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী।
বিনিয়োগকারীরা এখানে অভিজ্ঞ লোকদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমরা হয়তো রিকমন্ডেন্ট করতে পারি।
বাংলাদেশি পণ্যের কিছু কথাও তুললেন আব্দুল কাদের। বললেন, বাংলাদেশি পণ্য সিঙ্গাপুরে এখনো বিশ্ববাজার ধরতে পারেনি। ভিন্ন জাতিগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা ভারতীয় পণ্যের তুলনায় কম।
তিনি এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি আরো বলেন, এখানে আমরা ছোট ব্যবসা থেকে শুরু করে বড় হয়েছি। আমরা রেমিটেন্স পাঠাই দেশে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে কিছু ব্যবসায়ী দেশের টাকা পাঠাচ্ছে বিদেশে। দেশের কালো টাকা এখানে এসে বিনিয়োগ করছে।
** ‘বাকিতে ঘুষ খাওয়া’ মালয় পুলিশ
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৪