ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

টার্গেট বাংলাদেশি শিক্ষার্থী

মালয়েশিয়ায় অসৎ প্রতিষ্ঠান ‘টিএমসি কলেজ’

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪
মালয়েশিয়ায় অসৎ প্রতিষ্ঠান ‘টিএমসি কলেজ’

কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে: বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ব্যাঙের ছাতার মতো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে মালয়েশিয়াতে। এমনি একটি প্রতিষ্ঠান টিএমসি কলেজ।

পার্ট টাইম চাকরি আর শিক্ষার উন্নত মানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাচ্ছে এ কলেজ। পরবর্তীতে ভিটে-মাটি বিক্রি করে বিদেশ যাওয়া এসব শিক্ষার্থীদের ফিরতে হচ্ছে সর্বশান্ত হয়ে।
 
মালয়েশিয়ার বাজারে কলেজ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে টিএমসি কলেজের। কুয়ালালামপুরের ৮৫ জালান লোক ইয়োতে মেনারা উচাং এমাসের ব্লক এ’র গ্রাউন্ড ফ্লোর ভাড়া নিয়ে চলছে কলেজের কার্যক্রম। এখানে বর্তমানে প্রায় দুইশ’ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।

মালয়েশিয়াতে স্টুডেন্ট ভিসায় কাজ করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রলোভন দেখানোর জন্যে বাংলাদেশে দালালদের পছন্দের কলেজ টিএমসি। কলেজের তত্ত্বাবধানেই শিক্ষার্থীদের প্রতারণা করা হয় এখানে।
 
বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন যাত্রাবাড়ির ছেলে রাসেল।

তিনি বাংলানিউজকে জানান, টিএমসি কলেজ একটি প্রতারণার ফাঁদ। পরিচিত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ৬ মাস আগে এই কলেজে এমবিএ করতে আসেন তিনি। কিন্তু এটি মূলত একটি কোচিং সেন্টার ধরনের কলেজ।

প্রতারিত হয়ে এক সময়কার এ মেধাবী শিক্ষার্থী এখন পাকিস্তানি একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন শুধু থাকা আর খাওয়ার খরচ জোগানোর জন্যে।
কলেজে ভর্তি হতে এবং মালয়েশিয়া আসতে সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছ রাসেলের।

রাসেল বলেন, এখানে আসার আগে ধারণা ছিলো পার্ট টাইম চাকরি করে মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। তবে বাস্তবের সঙ্গে এ ধারণার মিল নেই।
 
টিএমসি কলেজে অধ্যায়নরত বেশিরভাগ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বাস করেন মসজিদ জামেক এলাকায়। সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালয়েশিয়া সরকার থেকে শিক্ষার্থীদের কাজ করার অনুমতি না থাকলেও, কলেজটি শিক্ষার্থীদের সেই সুযোগ করে দেয়। এ কলেজে সপ্তাহে একদিন উপস্থিত হয়ে বাকি ৫ দিনের স্বাক্ষর করা যায়। এখানে পড়াশোনা হয় না, বললেই চলে।
 
ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শোয়েব এখন টিএমজি কলেজে হোটেল ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে টিএমসি কলেজের যেসব এজেন্ট রয়েছেন, তারা শিক্ষার্থীর জন্যে বড় অংকের কমিশন পান। এখানে কলেজটি পার্ট টাইম কাজের জন্যে সুযোগ করে দেয়। তবে এ আয় কলেজ কর্তৃপক্ষকেই দিয়ে যেতে হয়।
 
বিবি প্লাজায় একটি রকমারি দোকানে কাজ করেন শোয়েব। দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করে তিনি আয় করেন দৈনিক ৩০ রিঙ্গিত (৭৫০ টাকা)। ওভারটাইমের জন্যে পান ৩ রিঙ্গিত করে। মাস শেষে ১০০০ রিঙ্গিতের মতো আয় হয়।
 
শোয়েব বলেন, বাবা-মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশ থেকে পাঠিয়েছেন। ভেবেছেন পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম কাজ করে এখান থেকে ভালো আয় করবো। দেশেও কিছু আর্থিক সাহায্য করতে পারবো। অথচ এখানে নিজের বেঁচে থাকাটাই এখন যুদ্ধ। দোকানে আয়ের জন্যে কুলির কাজটাও করতে হচ্ছে।
 
একই কলেজের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রুহুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, এখানে পালিয়ে কাজ করতে হয় আমাদের। শিক্ষার্থীদের কাজ করতে দেখলে, পুলিশ ধরে হয়রানি করে। একবার ধরলেই ১০০ থেকে ২০০ রিঙ্গিত দিয়ে ছাড়া পেতে হয়। আর থানায় নিয়ে গেলে ১০০০ রিঙ্গিতের নিচে ছাড়া পাওয়া যায় না।
 
তিনি আরো জানান, এভাবে কষ্ট করে আয় করে টাকা জমাতে হয় আমাদের। টাকা জমিয়ে বছর শেষে সাড়ে ৭ হাজার রিঙ্গিত (১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা) তুলে দিতে হয় কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। এই সিমেস্টার ফি না দিলে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভিসা দেন না নতুন করে। ভিসা না পেলে অবৈধ হয়ে যেতে হয় আবার।
 
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, টিএমসি কলেজ একটি দুষ্টচক্রে ফেলেছে তাদের। এখানে অবৈধভাবে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। আবার আয় করে কলেজ কর্তৃপক্ষকেই টাকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। এই চক্র থেকে বের হতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত অবৈধ হয়ে যান এবং শিক্ষাজীবন ঘুচিয়ে শ্রমিকের খাতায় নাম লেখান। সে ক্ষেত্রে অন্তত মাসের বেতনটা নিজের থাকে।
 
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে টিএমসি কলেজ এ দেশেই খুলেছে তাদের রিজিওনাল অফিস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সোহেল মাসুদ, যিনি বর্তমানে মালয়েশিয়াতে অবস্থান করছেন। আর বাংলাদেশে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ মুনির।
 
টিএমসি কলেজের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভারত আর আফগানিস্তানের জন্যে সোহেলের অফিসকে রিজিওনাল ব্রাঞ্চ বলা হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত বাংলাদেশের শিক্ষার্তী ছাড়া এখানে অন্য দেশের কোনো নাগরিক আসেন না।
 
পরিচয় গোপন রেখে রোববার সকালে মুনিরের সঙ্গে কথা বললে, তিনি প্রতিবেদকেও পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের প্রলোভন দেখান। বলেন, সপ্তাহে মাত্র দুই দিন ক্লাস করে, বাকি দিন কাজ করা যাবে। প্রথম ২ বা তিন মাস কষ্ট হলেও পড়ে কাজ ম্যানেজ হয়ে যায়। মালয়েশিয়াতে ৩০০ থেকে ৫০০ রিঙ্গিতে (৭ থেকে ১২ হাজার টাকা) অনায়াসে থাকা খাওয়া হয়ে যায়।
 
কলেজটিতে ডিপ্লোমা কোর্স করা যায় বলেও জানান তিনি। এভাবেই প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের প্রতারণা করে যাচ্ছে টিএমসি কলেজ এবং এ দেশীয় প্রতিনিধিরা।
 
কলেজটির ওয়েবসাইট: http://tmc.edu.my/
 
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ