কুয়ালামপুর: মালয়েশিয়ার পথে পথে ঘুরছি। পানতাই মুরনির ব্যস্ততম মালয় এলাকায় চোখে পড়ে ‘যশোর সেলুন’।
রহস্য বের করতে ছোট সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠতেই দেখা মিলল আরও একটি সাইন বোর্ডের। সেখানে লেখা-দিলীপ। পাশে দেওয়া আছে মুঠোফোন নম্বরও।
ফোনে কল করতেই অপর প্রান্তের জবাব, ‘ভাই আমি একটু বাজারে আছি। দোকানের খাবার খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছি। নিজে রান্না করবো বলে সওদা করতে এসেছি। আপনি চলে যাইয়েন না। আমি আসতেছি। ’
মিনিট দশেক পরেই দেখা পেলাম সদা হাস্যোজ্জ্বল ও মিষ্টভাষী মানুষটির। একবারও মনে হয়নি এটাই তার সঙ্গে আমার প্রথমবারের দেখা।
পুরো নাম দিলীপ চন্দ্র দাশ। বাড়ি ফেনী জেলার পশুরাম উপজেলার শলিয়া গ্রামে। দেখা পেয়ে নিজেই বর্ণনা করলেন নিজের সংগ্রামী আর প্রবাস জীবনের ইতিহাস!
জানালেন, তার মা মানুষের বাসায় কাজ করতেন। মায়ের রোজগারেই সংসার চলত।
স্মৃতির ফ্ল্যাশবাক আওড়িয়ে এই প্রবাসী বলেন, তখন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। মা আমাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দেন। সেই যে কাজ শুরু, এখনও কাজের মধ্যেই আছি।
যে সময়টা দিলীপের পড়াশোনা কিংবা পাড়া বেড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা। সেই সময়টায় ঠিক তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল কঠিন বাস্তবতার। শৈশবেই মায়ের আঁচল ছেড়ে অন্যের সাংসারিক কাজ করতে হয়েছে তাকে।
‘ মা, কাছে ছিল না। সব সময়ই মার কথা মনে পড়তো, কাজে মন দিতে পারতাম না। ’ – বলেন আবেগাপ্লুত দিলীপ।
দিলীপের চলনে-বলনে এতই চমৎকার যে বোঝার উপায় নেই যে তিনি অক্ষর জ্ঞানহীন। তাই তাকে বলা যায়, স্বশিক্ষিত সরল প্রাণের মানুষ।
মাথার চুল কাটাতে বসে গেলাম তার কাছেই। এর ফাঁকে হলো অনেক গল্প।
দেশ প্রসঙ্গে বললেন, মন সব সময় দেশেই পড়ে থাকে, ভাই। এখন বেশ আতঙ্কে থাকি। দেশের দাঙ্গা-ফ্যাসাদের খবর প্রতিদিন পাই। বারবার বাড়ির খোঁজ খবর নেওয়া লাগে।
জানালেন, ছোট বেলায় অর্থ সংকটে পড়াশোনা হয়নি তার। পড়াশোনার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চান ছেলে-মেয়ের মাধ্যমে।
দিলীপের দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে অষ্টম এবং ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটি পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে।
১৯৯৩ সালে বিয়ের পর থেকেই আর্থিক স্বচ্ছলতা ও শান্তির খোঁজে প্রবাসে জীবন যুদ্ধের মুখোমুখি তিনি। এত কিছুর মধ্যেও দিলীপ প্রতি বছর গ্রামের এতিমখানায় অর্থ দান করেন, ঈদের সময় চাল-তেল কিনে দেন।
আলাপে প্রকাশ পেল-মায়ের প্রতি অগাত শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। রয়েছে কৃতজ্ঞতাও। সর্বদাই মায়ের খোঁজ রাখেন।
কেমন আছেন মালয়েশিয়ায়? এমন প্রশ্নে দিলীপ বলেন, সকল প্রশংসা সৃষ্টিকর্তার। নয় তো আমার মতো একজন ক্ষুদ্র ‘নাপিত’ আজকে বিদেশে কাজ করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। এর চেয়ে বেশি কী আশা করতে পারি?
‘আমি ভালো আছি এবং কোনো অভিযোগ নেই আমার। দেশের সমস্যা থাকবেই। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সেই সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। অন্যতায় অনেক পিছিয়ে যাবো আমরা। ’ বলে চলেন এক নাগারে।
দিলীপের ‘যশোর সেলুনে’র কাস্টমার বেশি মালয়েরা। তাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় এবং সমাদৃত তার সেলুন। বাংলাদেশি হিসেবেও বেশ নাম অর্জন করেছেন এই পেশায়। অর্থ সংকটও দূর হয়েছে তার।
১৯৯৫ সালে প্রথম মালয়েশিয়ায় আসেন তিনি। এরপর ২০০০ সালে ফেরত যান দেশে। ২০০৮ সালে আবারও পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। তবে দালালের খপ্পড়ে পড়ায় তার পাসপোর্টে ভিসা লাগেনি। প্রায় এক মাস মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে অবস্থান করেন তিনি। ২০০৯ বাংলাদেশিদের বৈধ করার সুযোগ এলে তা লুফে নেন দিলীপ।
২০১২ সালে ডিজিটাল পাসপোর্ট করতে সক্ষম হন দিলীপ। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন সাংবাদিক গৌতম রায়কে ধন্যবাদ জানান তিনি।
কফি পানের দাওয়াত দিয়ে দিলীপ বলেন, ভাই অবশ্যই আসবেন। চুল না কাটলেও ঘুরতে আসবেন। বাংলাদেশিদের দেখলে আত্মা শান্তি পায়।
দিলীপের সেই কথায় অবচেতন মন বলে-আমরা অদ্ভুত জাতি, নিজেদের ছাড়াও থাকতে পারি না, আবার নিজেদের নিয়েও থাকতে পারি না।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫