কুয়ালালামপুর (মালয়েশিয়া): রাতে বাসায় ফিরে প্রফেসর মো. নাসিমুল ইসলামের ফেসবুক মেসেজ। ইউআইটিএম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরসেনিক বিভাগের এই প্রফেসর যেমন জ্ঞানী তেমনি রসিক।
আগেই বলে রাখি, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি মিষ্টি খাবার অভিজ্ঞতা খুবই করুণ। প্রতি মিষ্টির বাটিতে একটি দুটি চুল, পোকা, মশা পাবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। অপরিষ্কার পরিবেশ এবং রেস্টুরেন্টের বাজে পরিবেশ আপনার বাংলাদেশের মিষ্টির প্রতি অনীহা সৃষ্টি করবে।
যাই হোক, স্যারের কথাতেই ভরসা। সুবাং জায়া রেল স্টেশনে মোটরসাইকেল রেখে স্যারের গাড়িতে যাত্রা। গাড়িতে উঠতেই বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, ভালো মিষ্টি। আমার মনে হয়, ওদের খবরটা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। ’
সুবাং এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে কোটা দামানসারা এর রাস্তা ধরে যাচ্ছি। বিশাল বিশাল পিলার দিয়ে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। আর কয়েক বছরেই আরও উন্নত মেট্রো সিটিতে রূপ নেবে কুয়ালালামপুর ও এর আশপাশের শহরগুলো।
১৫ মিনিটের রাস্তা শেষ করে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। চার তলার একটি ছোট ভবনের নিচতলা বন্ধ। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই মিষ্টির গন্ধ পাচ্ছিলাম। উপরে উঠেই দেখি এক এলাহি কারবার। বিশাল বিশাল প্রায় চারটি কড়াইয়ে তৈরি হচ্ছে মিষ্টি। বড় মিষ্টি , ছোট মিষ্টি, বুন্দিয়া, ছানা মিষ্টি, দই, রশমালাই, শুকনো চমচম, ভেজা চমচম।
প্রায় পাঁচ জন কর্মচারী কাজ করছেন। এক পাশে থাকার জায়গা আর অপর পাশে মিষ্টি তৈরির ব্যবস্থা। তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রথমেই আমার নজর-কাড়ে। অতি যত্ন সহকারে নানা কৌশলে পারদর্শিতার সাথে মিষ্টি বানাচ্ছেন তারা।
শত ব্যস্ততার মাঝেও দোকানের মালিক রিপন শিকদারের আতিথেয়তার শেষ নেই। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কোথায় বসতে দেবেন। কাজ ফেলে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ব্যবসা যাত্রাশুরুর গল্প।
রিপন শিকদারের বাড়ি শরিয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকার ইউনিয়নে। ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ায় আসেন এবং ফার্নিচারের দোকানে কাজ শুরু করেন। ভালোই যাচ্ছিল দিনগুলো। এরপর ২০১২ সালে তিনি কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে কাজাংয়ে একটি মিষ্টির দোকানে চাকরি নেন। সেখানে বেশ কয়েকদিন কাজ করার পর, মালিকের বিভিন্ন খারাপ ব্যবহারের জন্য কাজ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
বিভিন্ন হুমকি এবং হয়রানির শিকার হতে হয় রিপনকে। কিন্তু ভালো কাজ করার প্রত্যয়ে অটল ছিলেন তিনি। শত বাধা বিপত্তি থাকলেও এগিয়ে যাবার স্বপ্ন বারবার তাকে জাগিয়ে তুলছিল। এরপর মালয়েশিয়ায় থাকা এক দূর সম্পর্কের মামার শরণাপন্ন হন তিনি। রিপনের মেধা, পরিকল্পনা এবং মামার স্বল্প পুঁজিতে গড়ে ওঠে ‘হালাল সুইটস’।
প্রথম দিকে রিপন বাংলাদেশি এলাকাগুলোতে মিষ্টি নিয়ে যেতেন, তার কথা ছিল, ‘আমার মিষ্টি টেস্ট করে দেখেন, যদি কোয়ালিটি ভালো হয় তাহলে নেবেন, কোনো জোর করব না’।
রিপনের মিষ্টি মন কাড়ে অনেকের। জমে ওঠে তার ব্যবসা, বেড়ে যায় চাহিদা।
কথা বলার মাঝে হাত ধুয়ে রিপন গরম গরম রসমালাই নিয়ে এলেন। মাথা থেকে চুয়ে পড়ছে ঘাম। তবুও মুখে হাসি লেগে আছে তার। বলেন, ‘স্যার এটা গরম গরম খান, অনেক ভালো লাগবে!’
গল্প গড়ায় , তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় প্রতিদিন প্রায় ৪০০ কেজি দুধের মিষ্টি তৈরি হচ্ছে। মিষ্টির চাহিদা বাংলাদেশির পাশাপাশি নেপালি, মালয়, পাকিস্তানি, ভারতীয়দের কাছেও জনপ্রিয়। চাহিদা মতো পৌঁছে দেওয়া হয় তাদের দোকানে দোকানে। কুয়ালালামপুর, সেলাঙ্গর এবং কাজাং এসব স্থানে এখন জনপ্রিয় হচ্ছে রিপনের ‘হালাল সুইটস’র মিষ্টি।
আগামীতে, কুয়ালালামপুর ছাড়াও মালাক্কা, পেনাং, জোহর অঞ্চলে মিষ্টি পৌঁছে দেবে হালাল সুইটস। পরিকল্পনামতো কাজ করার জন্য দোয়া চাইলেন রিপন।
মালয়েশিয়ার বুকে বাংলাদেশি খাবারের যোগান দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ রিপনকে, ধন্যবাদ হালাল সুইটসকে এবং ধন্যবাদ নাসিমুল ইসলাম স্যারকে।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫