ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

মানবপাচার: থাই-মালয়েশীয় পুলিশও অর্থভোগী!

মাহমুদ খায়রুল, কুয়ালালামপুর করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৪ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
মানবপাচার: থাই-মালয়েশীয় পুলিশও অর্থভোগী!

মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়ার লংকাউই ও ইন্দোনেশিয়ার বান্দার আচেহ মাঝ সমুদ্রের ট্রলার থেকে প্রায় ১,০১৮ জন বাংলাদেশি এবং মায়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করেছে ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ।

এদের মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশি এবং ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা নাগরিক।

এদের মধ্যে ৯৯ জন নারী ও ৫৪ জন শিশু রয়েছেন।

উদ্ধারদের আচেহ প্রদেশের লোকসুকন স্টেডিয়ামে রাখা হয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দালালচক্রের সদস্যরা আটক হতে পারেন, সে ভয়ে এই সব অভিবাসীদের বন্দরের কাছে ফেলেই পালিয়ে গেছেন।

এদিকে, মুক্তিপণ দিয়ে বেঁচে আসা এক অভিবাসী বাংলাদেশি ইসমাইল অভিযোগ করেছেন, পাচারকারী চক্রের সঙ্গে থাই এবং মালয়েশীয় পুলিশও অর্থভোগী। তিনি অভিযোগ করেন, পাচারকারীদের পুলিশকে অর্থ দিতে দেখেছেন।

গত ১ মে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তের গহীন জঙ্গলে অভিযান চালায় থাইল্যান্ডের পুলিশ-সেনাবাহিনী। এ সময় এই গহীন জঙ্গলে গণকবরের খোঁজ পান তারা। এ ছাড়া অনেক রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মুখ থেকে বের হয়ে আসে মানবপাচারকারীদের নির্যাতনের ভয়াবহ কাহিনী।

মানবপাচারকারীদের এ সব নির্মম অত্যাচারের চিত্র সারাপৃথিবী জুড়ে আলোড়ন তোলে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দাবির মুখে সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে সেনাবাহিনী বিভিন্ন অভিযান ক্যাম্প চালু করে।

এ খবর ছড়িয়ে পড়ামাত্রই জঙ্গলে ঘাঁটি করা দালালচক্রের সদস্যরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর পাচার হয়ে আসা নৌকাভর্তি শত শত অসহায় মানুষ আর তীরে ফিরতে পারছেন না।

একেকটি নৌকায় প্রায় এক থেকে দেড় মাস সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এ সব ট্রলার/নৌকা থাইল্যান্ডে পৌঁছায়। এরপর থাইল্যান্ডের জঙ্গলের বিভিন্ন ঘাঁটিতে আটকে রেখে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হলে তাদের আর জীবিত ফেরা হয় না।

পরিকল্পিত ফাদ:
পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বিভিন্ন পাচারকারী চক্র সুপরিকল্পিতভাবে অনেকদিন ধরেই পাচারের কাজটি করে আসছে। তবে এর আগে এভাবে অভিযান পরিচালিত না হওয়ায় মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ভাগ্য বদলের আশায় মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে দালালদের হাতে আটক হয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অঘোরে প্রাণ দিয়ে আসছিলেন।

এদিকে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং গ্রামে পাচারকারীদের দালালচক্র রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক কম টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে  এ সব হতদরিদ্র বাংলাদেশিদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতো।

বাংলানিউজকে এ রকমই লোমহর্ষক একটি যাত্রা কাহিনী বর্ণনা করেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার  নাসিরনগর থানার আব্দুল লতিফ। মাত্র এক মাস আগে তিনি এই দালালচক্রের শিকার হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।  

তিনি জানান, অনেক দিন থেকেই ইসমাইল নামে এলাকার এক বড়ভাই তাকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য বলছিল। প্রথমে তিনি রাজি হননি। কিন্তু ঢাকায় তার ব্যাগের ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় হতাশ হয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সামনের যাত্রা যে এমন কষ্টের হবে, তা ছিল কল্পনার বাইরে।

আব্দুল লতিফ জানান, প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে ছোট ছোট নৌকায় করে ৩০-৪০ জনকে মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি একটি চরে জমা করা হয়। এভাবে দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে নৌকায় করে পর্যায়ক্রমে আট থেকে ১০টি নৌকায় করে মানুষ আনা হয়। একইভাবে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদেরও আনা হয়।

এরপর তাদের বড় একটি মাছধরা ট্রলারে তোলা হয়।

লতিফ বলেন, এই নৌকাগুলোর ধারণ ক্ষমতা খুব বেশি হলেও ৬০-৮০ জন।   অথচ সেখানে একই সঙ্গে ৫০০-৬০০ জনকে তোলা হয়। যতদিন পর্যন্ত ৫০০-৬০০ জন না হয়, ততদিন পর্যন্ত ট্রলার ছাড়ে না। যদি কেউ খাবার নিয়ে ওঠে। তারা সেই খাবার ও পানি কেড়ে নেয়।

তিনি জানান, বাংলাদেশি দালালরা শুধুমাত্র মায়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত থাকে। এরপর আর তাদের পাওয়া যায় না।

চলে অসহনীয় অত্যাচার:
এরপর এক মাস ধরে চলে সমুদ্র যাত্রা। খাবারের জন্য দেওয়া হয়, সাদা ভাত এবং শুকনা মরিচ। পানি দেওয়া হয়, আধাগ্লাসেরও কম। কেউ যদি এরপরও পানি চায়, তাহলে তাদের চাবুক মারা হয়।

লতিফ বলেন, চাবুকগুলো একটা বিশেষ উপায়ে তৈরি করা। গায়ে আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে চামড়া উঠে আসে।

তিনি জানান, শুধুমাত্র পানির অভাবেই অনেককেই তার চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছেন।

তিনি বলেন, খাবার না দিয়ে দুর্বল করে ফেলা হয় সবাইকে। নিজেদের মধ্যে কথা বললেও চাবুক দিয়ে আঘাত করা হয়। রক্তের গন্ধে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে পুরোটা সময়।

ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আব্দুল লতিফ জানালেন, যাত্রা এখানেই শেষ হয় না। ৩০-৪০ দিনের যাত্রা শেষে থাইল্যান্ডের সীমান্তে নৌকা পৌঁছায়। এরই মধ্যে নৌকায় ২৫-৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং মরদেহ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, থাই সীমান্তে আসার পর রাত শেষে নৌকার সবাইকে তীরে নামানো হয় এবং পরে গহীন জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। জঙ্গলে ছোট ছোট বাঁশের খাঁচার ভেতর পুরে ফেলা হয় সেই রাতেই। এরপর শুরু হয় নতুন বর্বরতা।

এরপর তাদের সবার কাছে আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয়। ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়। নির্ধারিত অ্যাকাউন্টে দুইদিনের মধ্যে টাকা না আসলে পরিণাম হয়, মৃত্যু। যাদের মাত্র ৩০- ৪০ হাজার টাকায় আনা হয়েছিল, তাদেরকেও আড়াই লাখ টাকা দিতে হয়।

নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লতিফ জানান, অনেক বাংলাদেশির পক্ষেই এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। শেষে এদের কী পরিণতি হয়েছিল, তা তিনি জানেন না।

লতিফ নিজে তার এক চাচার কাছ থেকে টাকা এনে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি জানান, আটক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একরাত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে খালি পায়ে দৌঁড়াতে হয়েছে সবাইকে। একটুকু বিশ্রামের জন্যও সময় দেওয়া হয়নি তাদের। দাঁড়ালেই চাবুক দিয়ে আঘাত করা হতো।

লতিফ এক পর্যায়ে তার শরীর এবং পায়ের আঘাতগুলো দেখান। এ সময় তার চোখের কোণে জল ছল ছল করছিল।

তিনি জানালেন, মালয়েশিয়ার সীমান্তে প্রবেশের পর একটি ট্যাক্সি করে প্রায় ১৩-১৪ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়, তেরেঙ্গানু প্রদেশে। এ সময় গাড়ির পেছনে মাল রাখার বগিতে ৪-৫ জনকে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

প্রায় একঘণ্টা যাত্রার পর একটি এলাকায় আনা হয়। সেখানে একটি বাড়িতে তাদেরকে রাখা হয়। তবে এলাকার নাম বলতে পারেননি লতিফ। এখানে প্রায় ৮ হাজার টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়, জামা এবং কিছু খাবার। এরপরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

আব্দুল লতিফ জানালেন, এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ টাকা তিনি বাড়ি থেকে এনেছেন। তিনি যে বেঁচে আসতে পারবেন, তা কখনোই চিন্তা করতে পারেননি। নৌকায় আসার সময় তার পাশে থাকা দুই বাংলাদেশিকে তিনি মারা যেতে দেখেছেন। সেই স্মৃতি তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

লতিফ অভিযোগ করে বলেন, মালয়েশিয়ার পুলিশ, থাই পুলিশও এই পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পালিয়ে আসার সময় পুলিশকে অর্থ দিতে দেখেছেন দালাল চক্রের সদস্যদের।   

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ