মালয়েশিয়া থেকে ফিরে: কেন্দ্রের হতাশা ও শৈথিল্যের প্রভাব পড়েছে মালয়েশিয়া বিএনপিতে। সেই সূত্রেই স্থানীয় নেতারা রাজনীতিতে নয়, মনোযোগী হয়েছেন যার যার অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও গৎবাঁধা দৈনন্দিন জীবনযাপনে।
বিএনপির মালয়েশিয়া শাখার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপে এমন নৈরাশ্যের চিত্রই ফুটে উঠে।
এ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সালাহউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, এতদিন ব্যবসার দিকে মন দিতে পারিনি। এখন সেসব একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। দলের প্রতি ভালোবাসা ছিল, আছে, থাকবে।
সস্ত্রীক নিজের হোটেল ব্যবসায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছেন বলে জানালেন সালাউদ্দিন।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে মালয়েশিয়া বিএনপির সহ-সভাপতি মাজু দেলোয়ার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, অস্বীকার করছি না যে, বিএনপির নেতাকর্মীরা কিছুটা মন খারাপ করে আছেন। এর কারণ খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু। তার আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। কোকো সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও কোন না কোনভাবে তিনি সবার প্রিয় ছিলেন। তাকে যারা অতিরিক্ত পছন্দ করতাম, তারা শোক কাটাতে পারছি না। এতে কিছুটা সময়তো লাগবে।
দেলোয়ার বলেন, দলের জন্য আছি, থাকবো।
ক্ষমতা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া বিএনপির মালয়েশিয়া শাখার এক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলানিউজের কাছে নিজেদের অবস্থা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, সেভাবে আর মনোবল পাচ্ছে না কেউ, কর্মীরাও আগের মতো উৎসাহিত নন দলীয় কার্যকলাপে যোগ দিতে। বিদেশ-বিভূঁয়ে কাজ ছেড়ে রাজনীতি করছিলেন ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। একদিন লাভবান হবেন ভেবে।
‘কিন্তু এখন দলের কেন্দ্রই গন্তব্যহীন। নেতারা তাই মাঝে মাঝে দলের কিছু রুটিন অনুষ্ঠান করেই দায়িত্ব শেষ ভাবছেন। আর এক্ষেত্রে কেন্দ্রের উদাসীনতা অন্যতম প্রধান কারণ। এখানে সক্রিয় একটি শাখা থাকা সত্ত্বেও সেভাবে মনোযোগ দেয়নি কেন্দ্র’- বলেন তিনি।
এ নেতা জানান, কেন্দ্রীয় বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতারই মালয়েশিয়ায় বড় ব্যবসা ও সেকেন্ড হোম রয়েছে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকেন এদেশে এসে। দলের কোন কাজে সেভাবে উৎসাহ দেখান না তারা।
বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, মালয়েশিয়া বিএনপির বেশিরভাগ নেতা ব্যবসায় জড়িত এবং কর্মীরাও ব্যবসা বা চাকরি করেন। আর রাজনীতির অঙ্গনে আশার আলো না দেখে এখন সেসব দিকেই মন দিয়েছেন। ‘টাকায় টাকা আনা’র সূত্রে চলছেন ক্ষমতার স্বপ্নকে পাশ কাটিয়ে।
নাম না প্রকাশের শর্তে দলটির এক কর্মী বাংলানিউজকে বলেন, বড় কোন অনুষ্ঠান বা পুনর্মিলনী করার ক্ষেত্রে আগের মতো সাড়া মেলে না দলে। কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব এসে গেছে পুরো টিমে। আগে যারা দু’হাতে টাকা দিত অনুষ্ঠান সফল করতে, এখন তারাও সেভাবে আগ্রহী নন। একটা কথাই তারা ভাবছেন- লাভ কী এসব করে?
অথচ আগে বিএনপির মালয়েশিয়া শাখাটি ছিল প্রাণচঞ্চল, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বতো ছিলই, তবে সেসবও দলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই। নিজেদের আবেগ প্রকাশে নেতা-কর্মীরা থাকতেন মরিয়া। কে কার চেয়ে বড় অনুষ্ঠান করবেন, কার অনুষ্ঠানে কত বেশি লোক সমাগম হবে- সে প্রতিযোগিতা লেগেই থাকতো।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিশালী ছিল এ শাখা। নেতাকর্মীদের চলনে-বলনেও সে প্রভাব ধরা পড়তো।
মালয়েশিয়া বিএনপি ভাগ ছিল শহীদুল্লাহ গ্রুপ ও মাহবুব গ্রুপে। মো. শহীদুল্লাহ শহীদুল স্থানীয় বিএনপির একাংশের প্রস্তাবিত সভাপতি ও মাহবুব আলম শাহ অপর অংশের আহ্বায়ক। শহীদুল নিজের হোটেল ব্যবসা ও মাহবুব পর্যটনের ব্যবসায় বেশি সময় দিচ্ছেন। দলের সদস্য সচিব মোশাররফ হোসেনও মানবশক্তির ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত।
এর আগে দল নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চালু ছিল। কার কর্মী কত বেশি, কার প্রতি কেন্দ্রের সমর্থন কত বেশি বা কাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলে তারেক রহমান বেশি আস্থাভাজন মনে করেন- এসব প্রচারে ব্যস্ত থাকতেন তারা।
কিন্তু সে পরিস্থিতি বদলে গেছে। সম্প্রতি দলের সবচে’ বড় যে প্রোগ্রামটি হয়েছে, তা হল- দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালন।
সেদিন একই মঞ্চে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন এ নেতারা। এ মিলন যতটা না দ্বন্দ্ব ভুলে দলের স্বার্থে, তার চেয়ে পরিবর্তিত অবস্থায় বাধ্য হয়ে।
অথচ গত বছরের এ সময়টিতেই এখানে দলটির রূপ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত, অনেক চাকচিক্যের।
সেবার দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান আসেন মালয়েশিয়ায়। তার অনুষ্ঠানের আয়োজনে মালয়েশিয়া ছিল সরগরম। নিজেদের দ্বন্দ্ব ভুলে নেতা-কর্মীরা এক হয়ে কাজ করেন তারেকের সন্তুষ্টি লাভের আশায়। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিলেন সবাই। তারেককে ঘিরে বিপুল ব্যয় ও লোক সমাগম দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন অনেকে।
জানা যায়, মালয়েশিয়ায় বিএনপি নেতারা বেশিরভাগই বেশ অর্থ-সম্পত্তির মালিক। সেবার তাই নিজেদের অনেককিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন তারেকের জন্য।
খালেদার বড় ছেলে তারেকের সঙ্গে বেশ খাতিরের সম্পর্ক রয়েছে- এমনটি বোঝাতে নেতারা বারবার তার দর্শন পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাদের আচরণ ও কর্থাবার্তায় এ বিষয়ে একের প্রতি অন্যের ইর্ষাও ধরা পড়ছিল।
তারেক এলেন, ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে সুন্দর সময় কাটালেন লাঙ্কাউই দ্বীপে। মা খালেদা আসার কথা মিডিয়ায় চাউর হয়ে গেলে সে যাত্রা জিয়া পরিবারের পুনর্মিলনী হয়নি। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভালো কিছুর আশায় বুক বেঁধেছিলেন সব দেখে-শুনে।
মাত্র একটি বছরের ব্যবধানে বিএনপি এখন অন্য চেহারায়। দলটি হারিয়েছে অনেক কিছু। কেন্দ্রে দলপ্রধান খালেদা জিয়ার অসহায়ত্ব, নেতাদের পলায়নপর মনোবৃত্তি, জেল-জরিমানায় পর্যুদস্ত কর্মীরা, তারেকের মতিগতি বুঝতে না পেরে আশাহীন পুরো দল- সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মতো মালয়েশিয়ায়ও এখন অন্য বিএনপি- জানালেন নেতাকর্মীরা।
তারেক রহমানের সে অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত নেতাদের সঙ্গে বাংলানিউজ প্রতিবেদকের আলাপ হয়েছিল। এবারও একই সময়ে তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। কিন্তু প্রত্যেকেই অনেক পরিবর্তিত, ম্লান। সরাসরি এসব নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করছিলেন।
এদিকে বিএনপির এমন অবস্থা দেখে আনন্দিত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির অবস্থা দৃষ্টে তাদের কয়েকজনের বক্তব্যের সারমর্ম হল- ‘আগে বাংলা পত্রিকা ছিল, সেগুলোতে কাভারেজ পেতে মরিয়া হয়ে নানা উচ্ছ্বাস দেখাতো বিএনপি। এখন পত্রিকা নেই, অনুষ্ঠান করে পোষায় না। তাই ঝিম মেরে গেছে। ’
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আরও বলছেন- কেন্দ্র যেখানে ভেঙে পড়েছে, সেখানে ছায়াও একই হালে থাকাই স্বাভাবিক। খালেদা ও তারেকের অবস্থাই যেখানে করুণ, সেখানে মালয়েশিয়ার নেতাকর্মীরা কীভাবে সবল থাকে।
এক নেতা তো স্বীকারই করলেন, বিএনপির সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না তারা। এখন বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়ায় নিজেদের কিছুটা শক্তিশালী ভাবার অবকাশ পাচ্ছেন।
বিশেষ করে, স্থানীয় ছাত্রলীগ তাদের তৎপরতা জোরদার করেছে। দফায় দফায় সভা করে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রকেও দেখানোর চেষ্টা করছে যে, মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগ এখন গণ্য করার অবস্থানে পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৫
এমএন/এসকেএস/জেডএম