ঢাকা: মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারের অন্যতম শক্তি নেপাল ও ইন্দোনেশিয়া। এই দুটি শ্রমিকের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে বিতাড়িত হয়েছে মালয়েশিয়ার প্রযুক্তি কোম্পানি বেসটিনেট (Bestinet)।
মালয়েশিয়ায় কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের ভিসা প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়টি বেসরকারি ফার্ম বেসটিনেটকে দেয়া হয়েছিল। তবে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ গত জানুয়ারির শেষ দিনেই প্রতিষ্ঠানটির বিতর্কিত ভিসা প্রণয়ন ব্যবস্থা এবং বায়োমেট্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ব্যবস্থাটি বাতিল করেছে।
মালয়েশিয়ার ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডাব্লিউসিএমএস) এবং বায়োমেট্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা কার্যকর হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথাতেই এ নিষেধাঙ্গা আসে ফার্মটির ওপর।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এজেন্সিগুলো এফডাব্লিওসিএমএস এবং বায়োমেট্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে এবং তারা শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়।
অপারেটররা অভিযোগ জানান, বেসটিনেট নামে এই কোম্পানিটি কাজ নেয়ার পর শ্রমিকদের ভ্রমণ ফি ১৫ রিঙ্গিত থেকে বেড়ে এক লাফে ২৫০ রিঙ্গিত হয়ে যায়।
গত জানুয়ারির ২৬ তারিখে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন বিদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে আগের নিয়মে ফিরে যাওয়া ঘোষণা দেয়। ১৫ জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া বায়োমেডিকেল এবং এফডাব্লিওসিএমএস পদ্ধতি বাতিলের কথা বলে।
মালয়েশিয়ার বিদেশি শ্রমিক বিভাগের পরিচালক ফারাহ আদুরা হামিদি স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইমিগ্রেশন কাউন্টারের অধীনে আগের মতোই ভিসা আবেদন নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, উভয় পদ্ধতি বাতিলের নির্দেশনাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে, কিন্তু বিস্তারিত জানানো হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশনাটি দিয়েছেন এবং ইমিগ্রেশন বিভাগ এটি কার্যকর করবে।
বেসটিনেট শুধু এফডাব্লিওসিএমএস এর ওয়েবসাইটটির দায়িত্বেই নয়, বরং বিদেশি শ্রমিকদের কোটা, তাদের অস্থায়ী ইলেকট্রনিক পারমিট, ইন্স্যুরেন্স ও অন্যান্য বিষয় দেখভালের দ্বায়িত্ব নিয়েছিল। বেসটিনেট সিস্টেমের মাধ্যমে শ্রমিক রপ্তানি দেশগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হতো।
বেসরকারি এই আইটি ফার্মটির একজন পরিচালক হচ্ছেন মালয়েশিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তান শ্রী আজমী খালিদ এবং শ্রম বিভাগের সাবেক পরিচালক দাতুক টেংকু ওমর টেংকু বট।
বিদেশি সরকারসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়োমেট্রিক সিস্টেমের মাধ্যমে শুধু খরচ বৃদ্ধিই নয়, শ্রমিকদের তথ্যের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে।
মালয়েশিয়ার পিপলস জাস্টিস পার্টির (পিকেআর) সংসদ সদস্য দাতুক জোহারি আব্দুল এবং ইয়ুথ ইনফরমেশন চিফ লি চেন চুং বেসটিনেটের এই মনোপলির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তারা বলেন, তথ্যগুলো দেশের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং ইমিগ্রেশনের মতো স্পর্শকাতর। একটি কোম্পানির হাতে থাকায় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
এ ধরনের কাজ করতে দিয়ে কেন বেসটিনেটকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি ড. আহমেদ জাহিদ হামিদিকেব জানাতে বেশ কয়েকবার সময় দেন তারা।
এই মনোপলি প্রক্রিয়ায় এফডাব্লিওসিএমএস ও বায়োমেট্রিক সিস্টেমে বেসটিনেট শুধু যে বিস্তর ব্যাবসাই করবে তা নয়, কোম্পানিটি বিদেশি শ্রমিক আনার খরচও বাড়িয়ে দিয়েছে।
জোহারি এবং লি বলেন, পর্যবেক্ষণের বাইরে খরচ বৃদ্ধি হলে বিদেশি শ্রমিকদের শোষিত হওয়া এবং পাচার হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।
ইন্দোনেশিয়া এবং নেপাল প্রতিদিন শতাধিক শ্রমিক পাঠায় মালয়েশিয়ায়। এ দেশ দুটো ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তাদের শ্রমিকদের অতিরিক্ত খরচে এবং সিস্টেম থেকে তাদের চূড়ান্ত মনোনয়ন পেতে।
নেপালের রিক্রুটমেন্ট কোম্পানিগুলো ঘোষণা দেয়, তাদের সরকার যদি এ বিষয়ে কোন চূড়ান্ত স্বিদ্ধান্ত না দেয়, তবে নেপালি শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা হবে।
বায়োমেট্রিক সিস্টেম কার্যকর না করার জন্য নেপাল সরকারের প্রতি অনুরোধ করেছে সে দেশের সংসদ।
দেশটির আন্তর্জাতিক সর্ম্পক ও শ্রমিক সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির প্রধান আইন প্রনেতা প্রভু সাহা নেপালি শ্রমিকদের জন্যে বায়োমেট্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিরোধিতা করেন।
এর প্রভাব সর্ম্পকে না জেনে এই পদ্ধতি গ্রহণ না করতে সরকারকে মত দেয় সংসদীয় কমিটি।
সাহা বলেন, মালয়েশিয়ায় কাজ করতে ইচ্ছুক নেপালিদের বায়োমেট্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে সংসদীয় কমিটি।
তিনি বলেন, এই পদ্ধতিটি নেপালিদের জন্য দৃশ্যত কোন উপকারে আসবে না, বরং খরচ বাড়াবে শ্রমিকদের।
মালয়েশিয়ার সংবাদ সংস্থা বারনামা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ১ লাখের ওপর নেপালি শ্রমিক মালয়েশিয়া ছেড়েছে। দেশটিতে বর্তমানে সাড়ে সাত লাখের মতো নেপালি শ্রমিক কাজ করছে।
ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিক নিয়োগকারী কোম্পানিগুলোও বেসটিনেটের এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। তারা বলছে, এর ফলে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যাওয়াদের খরচ কয়েক গুন বেড়ে যাবে। তারাও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে।
তারা অভিযোগ করে বলেন, এটি শ্রমিকদের শোষণ করার একটি পদ্ধতি। মালয়েশিয়ার উচিত বিষয়টি নিয়ে ইন্দোনেশিয়া সরকারের সঙ্গে কথা বলা।
মালয়েশিয়ায় গৃহকাজ, ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ, প্ল্যান্টেশনসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে নেপালি ও ইন্দোনেশিয়ান শ্রমিকরা।
প্রতারণাপূর্ণ মেডিকেল রিপোর্টিং প্রতিরোধের নামেই শুরু হয়েছিল বায়োমেট্রিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা পদ্ধতি। ইমিগ্রেশন বিভাগ বলছে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্যে এ ব্যবস্থাটি পূর্ণরুপে চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে বেসটিনেট।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৫
এমএন/জেডএম