চীন থেকে ফিরে: মাত্র ছয় ঘণ্টা আগেই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সযোগে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিংয়ে পৌঁছেছি। গত বছরের ৮ মার্চ এয়ারলাইন্সটির এমএইচ ৩৭০ ফ্লাইট নিখোঁজ হওয়ার পর ওই ফ্লাইট নম্বর পরিবর্তন করে এমএইচ ৩৬০ রাখা হয়েছে।
হোটেল আগে থেকেই বুকিং ছিল। তাই এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি সেখানে পৌঁছাই। বেইজিং রাজধানী হলেও এখানকার খরচটা অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২৯০ চীনা ইউয়ান থেকে ৪১০ ইউয়ানের মধ্যেই (বাংলাদেশি ৩৫০০-৫০০০ টাকা) ভাল মানের তিন তারকা হোটেল পেয়ে যাবেন আপনি।
সকালে হোটেলের নাস্তার টেবিলে কোনো রকম যুদ্ধ করে খাবার সারলাম। কারণ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চামচ না পেয়ে চপস্টিক দিয়ে ১০ মিনিটের খাবার খেতে হল ৪০ মিনিটে। তাই চীনে ভ্রমণের ইচ্ছে থাকলে আপনাকে সেই চপস্টিক দিয়ে খাবার খাওয়া জানতে হবে অথবা সঙ্গে করে চামচ নিতে হবে।
আর হ্যাঁ, ভাষাগত দিক থেকেও ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য কিছুটা কঠিন চীন। কারণ, অনেক কম ইংরেজি জানা মানুষ পাওয়া যাবে এখানে।
পরদিন। রাজধানী বেইজিংয়ের ব্যস্ত সকালে শিজিমেন স্টেশন থেকে টিকিট কেটে ট্রেনে রওয়ানা হলাম। গন্তব্য সেই বহুকালের, বহু আকাঙ্ক্ষার অবাক করা স্থাপত্য মহাপ্রাচীর।
মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ট্রেনে জায়গা পাওয়ার জন্য সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ১-২ ঘণ্টা। তবে, ট্রেনের যাত্রায় এত ভিড়ের মাঝেও তাদের সু-শৃঙ্খলতা প্রশংসনীয় লেগেছে। দর্শনার্থীদের মধ্যে বুড়ো ও বাচ্চাদের সংখ্যা বেশি। নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যর দিক থেকে এই দেশটি অনেক গর্বিত, তা প্রথম থেকেই আঁচ করতে পেরেছি।
দীর্ঘ এক ঘণ্টার যাত্রার পর নজরে পড়ল বিখ্যাত সেই মহাপ্রাচীর বা গ্রেটওয়াল। পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথ বেয়ে আঁকা-বাঁকা সিঁড়ির মতো চলছে তো চলছেই।
চীনের মহাপ্রাচীরের ইতিহাস নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। পৌঁছাতেই ট্যুর গাইড জানালেন, দু’ভাবে উপরে যাওয়া যাবে। পায়ে হেঁটে অথবা টিকিট কেটে কেবল কারেও একদম উপরে। পায়ে হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছে-শক্তি থাকা সত্ত্বেও কেবল কার থেকে প্রাচীর দেখার কৌতূহলের কাছে হার মানলাম। ২৯০ ইউয়ানের টিকিটেই যাত্রা শুরু করলাম।
কেবল কার থেকে বাইরের দৃশ্য সত্যি অবর্ণনীয়। একদিকে বিশাল বিশাল পাহাড়, আরেক দিকে সেই আঁকা বাঁকা লম্বা মহাদেয়াল।
প্রাচীরের কিছু কিছু রাস্তার পর উঁচু মিনার রয়েছে। নির্মাণের সময়কার রাজার সৈন্য বাহিনীর প্রধানেরা এসব মিনার থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন বলে শোনা গেল। সবচেয়ে উঁচু মিনারটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৮০ মিটার উঁচুতে। আর এতোটাই লম্বা যে, তা প্রায় পনেরটি প্রদেশের উপর দিয়ে চলে গেছে।
উঁচু মিনারটি ছুঁয়ে দেখার আগ্রহ সবার মধ্যে বেশি। মিনারের গা ঘেঁষে ছবি তুলছে শত শত মানুষ। ভিড় সামলাতে নিয়োজিত প্রায় কয়েকশ’ পুলিশও নজরে এলো। বড় বড় সিঁড়ি বেয়ে উপরে যাওয়া এবং নিচে নামাও অনেক কষ্টসাধ্য। তাই মাঝ রাস্তাজুড়ে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে হাতলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিছু অংশ সিঁড়ির স্তর, আবার কিছু অংশ সমতল খাড়া। প্রাচীরের মাঝের রাস্তাটি প্রায় আড়াই মিটার প্রশস্ত আর পাহাড়ের পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট উপরে। তবে এটি সব স্থানে সমান্তরাল নয়। কোথাও কোথাও আকারের কম বেশিও রয়েছে।
দেয়ালের একেকটি ইট প্রায় আড়াই ফুটের সমান। কিছু কিছু সিঁড়ি আছে যা প্রায় এক মিটার খাড়া। উপরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে যেতে পারে সহজেই। কালো রঙের পাথর রয়েছে প্রাচীরের দু’পাশ ধরে। যতই দেখেছি, ততই বিস্মিত হয়েছি।
প্রতিদিন হাজারো লোক চীনের মহাপ্রাচীর দেখতে আসছেন। গোপন (সিসিটিভি) ক্যামেরায় সুরক্ষিত পুরো এলাকা। পথিমধ্যে কিছু কিছু স্থানে খাবার নুডুলস এবং পানীয় মিলবে। নুডুলসের প্রতি চীনাদের টান লক্ষণীয়। যতই ছবি তুলেছি, ততই অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে।
জানতে পারলাম, শীতকালে আরেক অপূর্ব চিত্র দেখা যায় এই মহাপ্রাচীরে। তুষারে সাদা সাপের মত দেখতে মনে হয় দূর থেকে। আর সেইসঙ্গে সূর্যের চিকচিকে রোদে এক অবর্ণনীয় রূপ নেয় ‘দ্য গ্রেট ওয়াল’।
মহাপ্রাচীর থেকে নামার সময় সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং’র বাণী চোখে পড়ল, ‘যে ব্যক্তি চীনের মহাপ্রাচীর বেয়ে উঠেনি, সে প্রকৃত পুরুষ নয়’। মুচকি হাসলাম, ‘এখন আমরা তাহলে প্রকৃত পুরুষ’। পরবর্তী গন্তব্য চীনের নিষিদ্ধ নগরী বা ‘ফরবিডেন সিটি’।
বাংলাদেশ সময়: ২২৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৫/০৯৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭
এইচএ/