কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া থেকে: মানবতার বিপর্যয়ের খবর যেমন বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসে তেমনি উল্টোপীঠে পাওয়া যায় কিছু কিছু মানবতার জয়েরও খবর। তেমন এক উদাহরণ মিললো মালয়েশিয়ায়।
বাবুল দুর্ঘটনায় পড়েন ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি। জোহরবাড়ুতে লোহা কাটার কারখানার শ্রমিক ছিলেন। অক্সিজেন ও অ্যাসিটেলিন গ্যাসের উত্তপ্ত মিশ্রন ব্যাবহার করে এ কাজটি করতে হয়।
দুপুরের দিকে কারখানার ভেতরে হঠাৎ স্টিলের বীম পড়ার বিকট শব্দ, আলোর ঝলকানি। আর তখনই বাবুল পড়ে যান গরম মিশ্রনের ওপর। পুড়ে যেতে থাকেন তিনি। দুঃসহ যন্ত্রনায় চিৎকার করতে থাকেন। তার মাংসের ওপরেই পোড়ার ভাগ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে চারিদিক। আর যখন চোখ মেলেন, তখন তিনি জোহরবারু জেনারেল হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন।
চিকিৎসকরা জানান, বাবুলের শরীরর ৪০ শতাংশই পুড়ে গেছে। তপ্ত আগুনে বাবুলের বাম পায়ের চামড়া ঝলসে যায় পুরোটাই, পিঠ থেকে শুরু করে নিতম্ব পুরো ঝলসে যায়।
দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে ওই হাসপাতালেই কাটে তার তিনটি মাস। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। এদিকে দেখা যায় বাড়তি সমস্যা। কারণ ওই সময়ে অবৈধ শ্রমিক হিসেবেই অবস্থান করছিলেন বাবুল।
সব মিলিয়ে তখন মৃত্যুর প্রহরই গুনতে শুরু করেছিলেন বাবুল। কারণ মালয়েশিয়াতে তার নিজের কেউ ছিলেন না।
বাবুলের দুর্দশার এই খবর পৌঁছায় মালয়েশিয়ার ক্লাংয়ে তার প্রথম কর্মস্থলে।
সেখানেই তার প্রথম নিয়োগকর্তা ছিলেন চীনা লি ইয়ং কি। ৪২ বছরের এই বিপত্নীক লিকই তখন এগিয়ে এলেন মানবতায় সাড়া দিয়ে।
নিজেই তিনি ছুটে আসেন জোহরবাড়ুতে।
অথচ স্রেফ বেশি মজুরির টানে প্রথম নিয়োগকর্তার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবুল। এমনকি সে কারণেই অবৈধও হয়ে পড়েন তিনি।
এবার বাবুলের সকল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন লিক। জোহরবারু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে বাবুলের যখন আশ্রয় নেওয়ার কোনও জায়গা থাকলো না তাকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গেলেন। আর শুধু তাই নয় হাসপাতালে বাকি পড়া ২ হাজার ৩৫৪ রিঙ্গিতও পরিশোধ করেন তিনি।
লিকের বাসায় বাবুলের অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। খোলা ক্ষতস্থানগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিলো। জীবানু সংক্রমনও হচ্ছিল।
দ্রুতই লিক তাকে ক্লাং জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে চলে দুই সপ্তাহের চিকিৎসা। এতে কিছুটা সুস্থ্য হয়ে ওঠেন বাবুল। তবে এখনো ইউরিন ক্যাথেটার ব্যাবহার করতে হচ্ছে। শরীরের পোড়া অংশগুলোতে এখনো মাংস জমতে শুরু করেনি।
হাসপাতাল থেকে বাবুলকে ফের নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যান লিক। সপ্তায় সপ্তায় বেসরকারি মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে ড্রেসিং করানো, সার্বক্ষণিক সেবার জন্য একজন শুশ্রুষাকারীও বাসায় নিয়ে আসেন লিক।
এক পর্যায়ে বাবুলের চিকিৎসা খরচ নাগালের বাইরে চলে যায়। এমনই সময়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বেসরকারি সংস্থ্যা ‘ঝু শি’র বিষয়ে জানতে পারেন। সেখানে আবেদন করা হলে ‘ঝু শি’ গ্রুপের মেডিকেল সার্ভিস টিম ‘টিমা’ এবার এগিয়ে আসে বাবুলের পাশে। সেখানেই এখন বাবুলের চিকিৎসা, নার্সিং চলছে।
‘টিমা’র একজন সদস্যের উদ্যোগে ক্লাংয়ের হোলি রেডিমার ক্যাথোলিক চার্চেও বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। গুরুত্ব নিয়ে চার্চ কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসে বাবুলের চিকিৎসায়। তারা মানবিক ও অার্থিক সহযোগিতা দিতে থাকে। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা আর্ন্তজাতিক সংস্থ্যা তেনাগানিতা বর্তমানে বাবুলকে আইনি ও চিকিৎসা সহায়তাও দিচ্ছে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে লিকের মানবতাই মুখে মুখে ফিরছে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশি কমিউনিটিতে।
ঝালকাঠি জেলার রাজপুরের মুটিয়াখালির ছেলে বাবুল মালয়েশিয়া যান ২০১২ সালে। ট্যুরিস্ট ভিসায় গেলেও একটি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে কাজ করার ভিসা কিনে নেন। এজেন্টের মাধ্যমে ক্লাংয়ে একটি ফার্মে কাজও পেয়ে যান। এতে তিনি বৈধই ছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাড়তি আয়ের জন্যে জোহরবারুতে অন্য একটি কোম্পানিতে কাজ নেন। তাতেই অবৈধ হয়ে পড়েন বাবুল।
তেনেগানিতার সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক প্রোগ্রাম অফিসার আশিকুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, জোহরবাড়ুতে ওই রডকাটার কারখানায় কোন সেফটি ইক্যুপমেন্ট ছাড়াই কাজ করতেন বাবুল।
বাবুলের প্রথম দিকের চিকিৎসা খরচ ওই কারখানা দিলেও এক পর্যায়ে তারা খোঁজ নেওয়া বন্ধ করে দেয় বলেই জানান এই স্বেচ্ছাসেবক।
আশিকুর জানান, দৈনিক ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো বাবুলকে। প্রথম মাসের বেতন সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে জমা দেয়া হয় কোম্পানিতে।
এসব কিছুই শ্রম আইনের লঙ্ঘণ জানিয়ে আশিকুর বলেন, বাবুলের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছে তেনেগানিতা।
বাংলাদেশ সময় ১০১০ ঘন্টা; সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৫
এমএন/এমএমকে