কুয়ালালামপুর (মালয়েশিয়া) থেকে: হরি রায়া এবার মলিন মালয়েশিয়ায়। রিঙ্গিতের মূল্যহ্রাস, ধরপাকড়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মিলিয়ে হারি রায়া হাজ এর উৎসবী আমেজ মিইয়ে গেছে।
মালয়েশিয়ায় ঈদুল আজহাকে বলা হয় হারি রায়া হাজ। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে এবারের হারি রায়া খুব একটা সুখের নয়। শুধু পশু কোরবানি নয়, মালয়েশিয়ায় এবার নিজেদের সুখও কোরবানি দিতে হয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের। অনেকেই টাকা পাঠাতে পারেননি বাড়িতে।
১৬ বছর ধরে মালয়েশিয়ার একটি ডেকোরেশন কোম্পানিতে চাকরি করছেন নরসিংদীর আবুল কালাম। সাধারণত ঈদে বাড়ি ফেরা হয়না তার। তবে দেশে থাকা সন্তান ও স্বজনরা যেন নিজেদের দেয়া কোরবানির মাংস খেতে পারেন সে চিন্তা থাকে তার মাথায়।
মেদান পাসারে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় কালামের। ঈদের কথা জিজ্ঞেস করতেই চুপ হয়ে যান তিনি। বলেন- দেশে ৭ বছরের একটি ছেলে এবং ৪ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে কালামের। এছাড়াও বাবা-মা, ভাই-বোনসহ প্রায় ৭ জনের পরিবার। এক কালামের উপার্জনেই চলে পেটগুলো।
কামাল বলেন, গত বছর এক রিঙ্গিতে বাংলাদেশি ২৩ টাকা পাওয়া যেতো। তবে এ বছর তা সাড়ে ১৭ টাকায় নেমে এসেছে। আয় না বাড়লেও বেড়েছে সব পণ্যের ওপর ভ্যাট। কুয়ালালামপুরে বাসা ভাড়া, খাবারের খরচ, ফোন কলের খরচ সবই বেড়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, রোজার ঈদে অনেক কষ্ট করে এক হাজার রিঙ্গিত জোগাড় করে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। তখন ২১ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। তবে এবার ১০ হাজার টাকার বেশি পাঠাতে পারিনি। এ টাকায় ৭ জন মানুষের সংসারে কিভাবে ঈদ পালন হবে জানি না।
কোতারায়ার একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন লক্ষ্মীপুরের যুবক সাদিক। তিনি বলেন, আমরা যারা বৈধ আছি তারা হয়তো কিছু অর্থ পাঠাতে পারছি, কিন্তু অবৈধদের অবস্থা আরো খারাপ। যারা কম মজুরির চাকরি করেন তাদের পক্ষে গত দুই মাস ধরে বাড়িতে টাকা পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না।
তিতিওয়াংসার বাংলাদেশি শ্রমিক নূরে আলম বাংলানিউজকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই চলছে ধরপাকড় ও পুলিশের হয়রানি। অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়েছেন। ভিসা নবায়ন করে দিচ্ছে না
কোম্পানিগুলো। দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় শ্রমিক ছাটাই করছে। শুধু তিতিওয়াংসার প্রায় ৫ শতাধিক শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়েছেন। ২০১৪ সালে হারি রায়া হাজ পালন করেছিলাম মালয়েশিয়ায়। তবে এবার প্রবাসী শ্রমিকদের মুখ অনেক বেশি মলিন।
ঈদুল ফিতরের সময় বাংলাদেশিদের ঈদের জামাত করতে অনুমতি দেয়নি মালয়েশিয়া প্রশাসন। গত ঈদ যেন বুঝতেই পারেননি প্রবাসীরা। তবে এবার অনেক আগে থেকেই সবাই জানেন ঈদগাহে একত্রিত হওয়া যাবে না, বলেন তিনি।
এরপরও নিজেদের দুঃখকে চাপা দিয়ে দেশে থাকা স্বজনদের ঈদকে সুখকর করে তুলতে চেষ্টার কমতি নেই প্রবাসীদের। প্রয়োজনে এ মাসে নিজেদের খাবারের খরচে একটু সংকোচন করেছেন অনেকে। অনেকে হেঁটেই যাতায়াত করেছেন অথবা, রেস্টুরেন্টে বসেও দেননি চায়ের অর্ডার। ৫০ সেন্ট, এক রিঙ্গিত করে জমিয়েই দেশে টাকা পাঠিয়েছেন।
পেতালিং জায়ায় একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে তিন মাস কাজ করেছেন বাংলাদেশের রাসেল। স্টুডেন্ট ভিসায় আসা এই তরুণকে তিন মাসে একটি রিঙ্গিতও বেতন দেয়নি কোম্পানি। মদিনা নামে একটি রেস্টুরেন্টে গত দুই মাস ধরে কাজ করছেন তিনি। গত সোমবার বাসায় ফেরার সময় স্টুডেন্ট ভিসায় কাজ করার অপরাধে পুলিশ তার কাছ থেকে ২শ’ রিঙ্গিতের পুরোটাই রেখে দেয়।
বলতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠে রাসেলের। সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া এসেছেন তিনি। ভাগ্য পরিবর্তনের সন্ধানে আসা রাসেলের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এদেশে ভাগ্য পরিবর্তনের পথ অনেক বন্ধুর।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৫
এমএন/এসইউ/জেডএম