ঢাকা: দুপুরের দিকে কারখানার ভেতরে হঠাৎ স্টিল বিম পড়ার বিকট শব্দ, আলোর ঝলকানি। আর তখনই পড়ে যান তিনি গরম মিশ্রণের ওপর।
বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি এক লোহা কাটার কারখানায় দুর্ঘটনার শিকার বাংলাদেশি শ্রমিক বাবুলের কথা। দুর্ঘটনায় তার শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে যায়। প্রথম দিকে চিকিৎসার খরচ কারখানা কর্তৃপক্ষ বহন করলেও পরে খোঁজ-খবর নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এমন সংকটময় মুহূর্তে চীনা নাগরিক লি ইয়ং কি, যিনি ‘লিক’ নামে বেশি পরিচিত, এগিয়ে আসেন। আর এগিয়ে আসে তেনেগানিতা (ওমেন’স ফোর্স)।
মালয়েশিয়ান মানবাধিকার কর্মী আইরিন ফার্নান্দেজ ১৯৯১ সালে তেনেগানিতা প্রতিষ্ঠা করেন। গত ২৪ বছর ধরে দেশটিতে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশেও কয়েকটি এনজিও’র সহায়তায় মানবপাচারের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে প্রচারণা। অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি জমাতে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের বিভিন্ন নীতি-নির্ধারক মহলের সঙ্গেও মানবপাচার রোধে করণীয় নিয়ে আলোচনা করে আসছে।
তেনেগানিতার সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক গবেষণা কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় জানান, মালয়েশীয় উপকূলে গড়ে প্রতি সপ্তাহে একটি করে অভিবাসীবাহী নৌকা ভিড়ছে। আর এসব নৌকার মোট আরোহীর ১৫ থেকে ২০ শতাংশই থাকে বাংলাদেশি।
অধিক আয়ের লোভে এই অভিবাসীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে বা অন্য রুটে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। এরা সবাই মানবপাচারের শিকার। এছাড়া অনেকে স্টুডেন্ট ভিসা, ট্যুরিস্ট ভিসাসহ বিভিন্ন খণ্ডকালীন ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমায়, কিন্তু পরে অবৈধভাবে সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। এদের সিংহভাগই দালালদের খপ্পরে পড়ে বলে জানান আশিকুর।
তিনি জানান, গত বছর (২০১৪ সালে) তেনেগানিতা ১৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ পেয়েছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। এগুলোর মধ্যে যৌন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন রকম নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে অভিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখন কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তেনেগানিতা মূলত শ্রম অধিকার, মানবাধিকার ও অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে বলে জানান আশিকুর। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে মালয়েশিয়ায় ৯০ লাখ বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে রয়েছেন ৬০ লাখ শ্রমিক।
তিনি জানান, মালয়েশিয়ায় কিছু চক্র সবসময়ই তৎপর। এদের খপ্পরে পড়ে অনেক প্রবাসী নারী শ্রমিক বা ছাত্রী পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন। তাদের বলপূর্বক এ পেশায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সঙ্গে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে গিয়েও অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া পুরুষ শ্রমিকরাও বিভিন্ন কর্মস্থলে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরা কিভাবে তেনেগানিতার কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছে জানতে চাইলে আশিকুর বলেন, যখন কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযোগের কথা জানায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিই আমরা।
অভিযোগ এলে কীভাবে সমাধান করা হয় জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপস-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। এভাবে কাজ না হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন অনুদানে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালিত হয় বলে জানালেন আশিকুর রহমান।
তিনি বলেন, তবে কোনো তামাক বা রাসায়নিক কিংবা রাবার প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো রকম অনুদান নেওয়া হয় না। সেই সঙ্গে বিশেষ উদ্দেশ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুদান দিতে চাইলেও তা নেওয়া হয় না।
বাংলাদেশে কিভাবে ও কি ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তেনেগানিতা, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কয়েকটি এনজিও’র সহায়তায় এগুলো পরিচালিত হয়। গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি জমানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় বিপদে প্রবাসীদের পাশে থাকার পাশাপাশি সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের সঙ্গেও আলোচনা করে কর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাচ্ছে বলে জানালেন তিনি। এছাড়া তেনেগানিতার উদ্যোগে সেখানে বিভিন্ন সময় প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫
আরএইচ/জেডএম