ঢাকা: ভাগ্য বদলের আশায় ২০১৩ সালের শেষ মাস থেকে ২০১৪ এর প্রথম ৫ মাসে উত্তাল সাগরে ভেসেছিলেন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যুবকরাও। স্বপ্নের জীবনের সন্ধানে তাদের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া।
বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের লাংসা ক্যাম্পে রয়েছেন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর দুই যুবক বাদল মণি ত্রিপুরা (২২) এবং আব্রাহাম ত্রিপুরা (১৮)। তাদের দুজনেরই বাড়ি বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের গতিরামপাড়া গ্রামে।
ফোনে তারা বাংলানিউজকে বলেন, গত ১০ মে থেকেই তারা লাংসা ক্যাম্পে রয়েছেন। লাংসার মানুষ বেশ আন্তরিক এবং তারা আন্তরিকতার সঙ্গেই তাদের গ্রহণ করেছেন। তবে এখন তারা দেশে ফিরতে মরিয়া।
বাদল মণি জানান, তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। এছাড়াও কিছুদিন চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে কাজ করেছেন। ৫ ভাই ২ বোনের সংসারে তার নিজের মেয়েও রয়েছে। এদের একটু সুখী করতেই অধিক আয়ের আশায় মালয়েশিয়া রওয়ানা হয়েছিলেন তিনি।
সম্পর্কে বাদলের ভাগিনা আব্রাহাম। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, মামা এবং আমাকে রামুর আবু নামে একজন দালাল মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। তবে সাগরের পাড়ে গেলে বুঝতে পারি, আমাদের বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আমাদের জোর করে নৌকায় উঠিয়ে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, সাগরে প্রায় ৩ মাস ছিলাম আমরা। নৌকায় মানুষ মানুষকে খুন করতো খাবারের জন্য। অনেকেই না খেয়ে, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছে।
বাদলের ছোট ভাই চন্দ্রমণি ত্রিপুরা সোমবার বাংলানিউজকে বলেন, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় ভাই আর আব্রাহাম বাড়ি থেকে চলে যায়। এখনো ভাইয়ের জন্য কাঁদছে পুরো পরিবার।
বাদল জানান, এখন পর্যন্ত তাদের বাড়িতে কোন ধরনের অনুসন্ধানে যায়নি সরকারের কেউ। তবে লাংসা ক্যাম্পে নিজের পরিচয়ের বিস্তারিত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তিনি কয়েকবারই জানিয়েছেন।
লাংসা ক্যাম্পে অবস্থানরত বাংলাদেশি শফিউল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, এই ক্যাম্পে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়ের ৩ যুবকও ছিলেন। উখিয়ার তেলপলা গ্রামের ৩ যুবকই ইতিমধ্যে ফেরৎ গেছেন দেশে।
এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ পাচারের শিকার হয়ে আন্দামান সাগর ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলে হারিয়ে গেছেন, তার কোন সঠিক সংখ্যা নেই। তবে নিখোঁজদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগে বোঝা যায়, সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়।
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্কং ইউনিয়নের আমতলি গ্রামের মংখাইন চাকমা। থাইল্যান্ডে মুক্তিপণের টাকা সরবরাহ করেও তার বড় দুই ভাই এবং চাচাকে বাঁচাতে পারেননি তিনি।
২০১৪ সালের অক্টোবরের ১৫ তারিখে, মামা তুই মং সিং চাকমার সঙ্গে দুই ভাই অজয় চাকমা (২৯) এবং মংথাইন চাকমা (২৪) রওনা হয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়।
ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে দ্বীন মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি মংখাইনকে ফোন দিয়ে জানান, তার আত্মীয়রা থাইল্যান্ডে রয়েছেন। তাদের জন্য প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
মংখাইনের বাবা ১৭ বছর আগে মারা গেছেন। তাই বৃদ্ধা মা এবং কিশোর মংখাইনের পক্ষে এতো টাকা দেয়া বেশ কঠিন ছিল। এরপরও ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে পাচারকারীদের কাছে পাঠান তারা।
অজয় চাকমা ছিলেন বিবাহিত এবং এক ছেলে ও মেয়ের জনক। এছাড়াও মংথাইন উখিয়া ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
মংখাইনের রিন্টু চাকমা নামে একজন ছোট ভাইও রয়েছেন। দ্বীন থাইল্যান্ড থেকে মংথাইনকে ফোন ধরিয়ে দিলে তিনি জানান, তারা আটকে রয়েছেন। তাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছেন বলে আকুতি জানান দুই ভাই। অর্থ পাঠিয়ে তাদের বাঁচিয়ে ফেরানোর জন্য অনুরোধ জানান।
তবে এক সপ্তাহ পরেই মংথাইন ফোন দিয়ে জানান, তুই মং সিং মারা গেছেন।
মংথাইন জানুয়ারির ১১ তারিখে ফোন দিয়ে অজয়ের মৃত্যুর খবর জানান। এক সপ্তাহ পর থাইল্যান্ডের ক্যাম্প থেকে ফোনে মংথাইনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়।
এছাড়াও টেকনাফের হয়াইকং ইউনিয়নের দিনমজুর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী উথেঙ্গো তঞ্চঙ্গ্যার মৃত্যুর খবর গত মে মাসে নিশ্চিত করে তার পরিবার।
আচেহ’তে অস্থায়ী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ইয়াইয়াসান জিউতানিয়োই’র (Yayasan Geutanyoe)। সংস্থাটির আন্তর্জাতিক পরিচালক লিলিয়ানে ফান (Lilianne fan)বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর দুজন তরুণ এখনো আচেহ’তে রয়েছেন।
তিনি বলেন, আচেহতে এখন যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন, তারা দেশে পরিবারের কাছে ফেরার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছেন।
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বাংলানিউজকে বলেন, আন্দামান সাগরের বিপজ্জনক যাত্রায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষও গেছে, এটা দুঃখজনক। সেখানে দেশে ফেরার পর কি হবে, সেটা ব্যক্তি নিজেও জানেন না।
দ্রুত আদিবাসী তরুণদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৫
এমএন/জেডএম