ঢাকা: জিটুজি প্লাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নেয়ার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাক্ষরের দিন দুই দেশের মন্ত্রী বা কর্মকর্তারা না বললেও প্রচার হয়ে আসছে, ৩ বছরে ১৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়া যাচ্ছেন।
মূলত বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া সরকার কোনো পক্ষই বিষয়টি গণমাধ্যমে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন না করার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমগুলো পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, জাহিদ হামিদির ঘোষণার পর থেকেই মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা এখন এ বিষয়ে চলমান রাজনীতির কেন্দ্রীয় ইস্যু। নাজিবের ২৬ লাখ রিঙ্গিতের ১ মিডিবি কেলেঙ্কারি অনেকটাই গণমাধ্যমগুলোতে চাপা পড়েছে এই ইস্যুতে।
বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণের দেশ মালয়েশিয়ার জনগণের বড় একটি অংশ যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়ার জাহিদ হামিদির ঘোষণা ভালভাবে নেননি সেটাও স্পষ্ট। বরং দেশটিতে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের জন্য জীবন-যাপন করে তুলেছে আরো একটু কঠিন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জানানো হয়, বাংলাদেশকে সোর্স কান্ট্রি স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক নেবে মালয়েশিয়া। অথচ এ ধরনের কোন সংখ্যার উল্লেখ নেই ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়টের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে। অথচ বিষয়টি ১৮ ফেব্রুয়ারি খোলামেলা বলা উচিত ছিল মন্ত্রণালয়ের।
খোলাখুলি না বলাতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ১৫ লাখ শ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবং মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমগুলো ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে। এমনভাবে সেখানে সংবাদগুলো প্রকাশ হয়েছে, যেন পরের দিন থেকেই ১৫ লাখ বাংলাদেশি গিয়ে নামছেন কুয়ালালামপুর শহরে। এর প্রভাব হয়েছে ভয়াবহ। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাস ঘেরাও করেছে মালয়েশিয়ান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের একটি গ্রুপ, ইখলাস। একইদিন সকালে বাংলাদেশি শ্রমিক না আনতে স্মারকলিপি দেয়া হয় উপ-প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে।
এই সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর হয়েছে ৫ বছরের জন্য। এ বিষয়টি স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে স্মারকের দিন। এরপরও মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমগুলো তিন বছরের কথাই উল্লেখ করে আসছে!
ঢাকার ওই মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নারী শ্রমিকদেরও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা বলা হয়। এরপর মালয়েশিয়ায় সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধীদের অনেকেই বাংলাদেশের মেয়েদের কটাক্ষ করে 'ঢাকা ডল' সম্বোধন করেন। এমনকি মালয়েশিয়ানদের সংসারে 'ঢাকা ডল'দের বিচ্ছেদ ঘটানোর সম্ভাবনা নিয়েও প্রতিবেদন করে দেশটির জনপ্রিয় দৈনিক দ্য স্টার। তবে নুরুল ইসলাম এবং রিচার্ডের করা সমঝোতা স্মারকে নেই নারী শ্রমিক প্রেরণের বিষয়টি। এ বিষয়টিও সেদিন পরিষ্কার করেনি দুই সরকার পক্ষের কেউই।
১৮ তারিখের কিছুদিন আগে থেকেই মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী জাহিদ হামিদি এবং ক্রীড়া মন্ত্রী খায়রি জামালউদ্দিন বলতে শুরু করেন, অবৈধ শ্রমিকদের নিবন্ধনের পর কাজে প্রেরণ করা হবে। এরপরই চাহিদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে নেয়া শ্রমিকদের নিয়োগ করা হবে। অথচ এর আগেই আমাদের মন্ত্রিসভায় ১৫ লাখ শ্রমিকের বিষয়টি অনুমোদিত হয়ে যায়!
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক তথা বিদেশি শ্রমিক বিরোধী একটি সমালোচনা দানা বাঁধে। এর ফলে বিদেশি শ্রমিকরা কোন অপরাধ করলে, প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার সঙ্গে এই বিরোধীরা ১৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের বিষয়টিও জুড়ে দেয়। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্য মালয় কনস্যুলেটিব কাউন্সিল নামে একটি এনজিও ১৫ লাখ বাংলাদেশি ইস্যুতে বলে বসে, তারা আসলে আমাদের দেশে রোগ বালাই বাড়বে এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছে যে, ঢাকায় সমঝোতা স্মারকের দিন সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরে ৩০ বছর বয়সী এক বাংলাদেশিকে মেরে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে ক্ষুব্ধ জনতা। অভিযোগ নয়, সন্দেহ করা হয়- একটি সাইবার ক্যাফের বাথরুমে ১৩ বছর বয়সী এক কণ্যা শিশুকে ধর্ষণ করেছে সে। তবে সন্দেহ বা অভিযোগ প্রমাণের আগেই মালয়েশিয়াতে এ ধরনের গণ নির্যাতনের কাণ্ড বিরল বলেই উল্লেখ করেছে প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো।
এক পর্যায়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেশটির পুলিশের আইজিপি বলেন, মালয়েশিয়ার মোট অপরাধের মাত্র ১ শতাংশ ঘটাচ্ছেন বিদেশি শ্রমিকরা। কারণ দেশটিতে বিদেশি, বিশেষ করে বাংলাদেশি শ্রমিক বিরোধী মনোভাব জড়ো হতে শুরু করেছে।
মালয়েশিয়ার অর্থনীতি এখন নিম্নমুখী। প্রতিনিয়ত পড়ছে রিঙ্গিতের মূল্য। ঢাকায় রিচার্ড স্পষ্টই জানিয়েছেন, তার দেশে শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ৯০০ রিঙ্গিত।
এবং সারোয়াকে এটি ৮০০ রিঙ্গিত। শ্রমিকের বাৎসরিক কর মালিকদের পরিশোধের কথা থাকলেও, এটা ওপেন সিক্রেট যে শ্রমিকের বেতন থেকেই কেটে নেয়া হয় এই করের অর্থ। সেই হিসেবে মালয়েশিয়ায় একজন বাংলাদেশি শ্রমিকের আয় টাকায় ১৪ হাজারের মতো। টাকার মতো। এই অংকের বেতন একজন শ্রমিকের জন্য কতটুকু ফলপ্রসু হবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার মন্ত্রণালয়ের।
গত জুন মাসে জাহিদ হামিদির বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার ঘোষণার পর থেকেই মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যবসায়িক শ্রেণী তাদের সরকারের কাছে চাহিদা তালিকা চেয়ে আসছে। বিশেষ করে এই শ্রমিক ব্যবসায় তার নিজের ভাই মোহাম্মদ হানিফের প্রতিষ্ঠান রিয়েল টাইমস নেটওয়ার্কের সংশ্লিষ্টতার খবর প্রকাশের পর। এছাড়াও শ্রমিক নেয়ার অনলাইন প্রক্রিয়াটির কাজ পেতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায় বেস্টিনেট এবং সিনারফ্লাক্স নামে দুই কোম্পানিও। ফলে বাংলাদেশেরও উচিৎ হবে মালয়েশিয়ায় কোন সেক্টরে আসলেই কত শ্রমিকের প্রয়োজন, তার সঠিক হিসেব নিয়েই নিজ দেশের মানুষ পাঠানোর সমঝোতা করা।
অবৈধদের বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দেয়ার পরও বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অবৈধ অভিবাসীদের আটক করছে মালয়েশিয়া সরকার। গত ৪৯ দিনেই ১৫০০ বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। এছাড়াও মালয়েশিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে বিচারহীনভাবে রয়েছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে বাংলাদেশিদের হয়রানি এবং অপমান করা হচ্ছে প্রতিটি ফ্লাইটেই। এসব বিষয়েও শক্ত অবস্থানে থেকে সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পারলে সন্মান হারাবে বাংলাদেশ। যার ফল পোহাতে হবে বর্তমানে সেখানে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫
এমএন/জেডএম