মালয়েশিয়া থেকে: বাসে চড়া মানে ঝাঁকুনির চোটে কোমর আর শিরদাঁড়ার যুদ্ধকালীন অবস্থা! বাসে চড়া মানে দীর্ঘ যানজটে আটকে গলদঘর্ম হওয়া! বাসে চড়া মানে বাসের গায়ে হেলপারের চাপড় মেরে বাস কোথায় যাবে সেটা বেসুরো গলায় চিৎকার আর ‘টিকিট কাটতে গিয়ে বেজার মানুষ, খুচ...খুচরো পয়সা নেই’!
নিশ্চিত বলতে পারি, কবির সুমন মালয়েশিয়ায় থাকলে এই গান অবশ্যই লিখতেন না তিনি।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বিমানবন্দর থেকে নেমে জালান পুডু যেতে হলে বাস ধরাই ভালো।
ট্রেনে সময় লাগে ৩৫ মিনিট কিন্তু পথে দু’বার নামতে হবে। তবে রিঙ্গিত বেশি খরচ করার ইচ্ছে থাকলে ট্যাক্সি ভাড়া করা যেতেই পারে।
জালাম পুডু কুয়ালামপুরে। এয়ারপোর্ট থেকে সেটাই আমাদের প্রথম গন্তব্য। বিদেশে এলেই মনের ভেতর একটা তুলাদণ্ড নিজের থেকেই কাজ করা শুরু করে দেয়।
এর একদিকে থাকে নদীমাতৃক বাংলাদেশ আর জন্ম থেকে দেখা কলকাতা আর অন্য দিকে থাকে যে শহরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তার চেহারা। এই অবস্থায় তুলনাটা এড়িয়ে চলা খুবই মুশকিল।
১০ রিঙ্গিত দিয়ে বাসে চেপে বসলাম। ১ রিঙ্গিত সমান ০.২৬ ডলার। কলকাতার বাসে চড়েছি হরদম, ঢাকার বাসের সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচিতি আছে।
তাই বাস দেখে মনে মনে মিলিয়ে নিলাম দুই শহরের বাসের সঙ্গে। বাসের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কুয়ালালামপুরের পথঘাট। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার অতিক্রম করে লোকজন খুব একটা দেখা যায় না। কিছু কিছু জায়গায় গ্রামের মতো জনবসতি। এগুলোকে নাকি ‘সিটি’ বলে।
বাসের গুণগত মান নিয়ে কথা বাড়িয়ে বিশেষ লাভ নেই। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, সুইচের মাধ্যমে দরজা খুলে যাওয়া ইত্যাদি সুবিধা যুক্ত এশিয়ার প্রায় সব শহরেই কমবেশি দেখা যায়।
কলকাতাতে এ ধরনের বাসের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু মূল পার্থক্য নিয়মানুবর্তিতায়। নিয়মানুবর্তিতা যে একই বিষয়কে কতোটা সুন্দর এবং সহজ করে দিতে পারে মালয়েশিয়ায় নেমে সেটাই সব’চে বেশি অনুভূত হলো।
বাস চালাচ্ছে একজন মালয়। সাধারণভাবে কলকাতা কিংবা ঢাকার বাসে থাকে একজন চালক, একজন টিকিট বিক্রেতা আর একজন হেলপার বা সহকারী। এই সহকারী বাসের গেটে ঝুলে গলা বাড়িয়ে বারেবারে বলতে থাকে বাসের গন্তব্য।
এখানে গোটা বিষয়টি নির্ভর করছে একজনের ওপর। যিনি চালক, তিনি টিকিট বিক্রেতা, তিনিই হেলপার। তবে এখানে তিনি গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করেন না। যাত্রীদের প্রয়োজন পড়লে সাহায্য করেন।
নিশ্চিন্তে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছেন চালক। গায়ে খাকি পোশাক মাথায় টুপি। সামনেই টিকিট কাটার যন্ত্র। শুধু বলতে হবে আপনি কোথায় যাবেন। টিকিট দিয়ে টাকা নিচ্ছেন তিনিই। আবার গন্তব্য এলে চালকের আসন থেকে নেমে বাসের পিছনে ‘লাগেজ স্টোর’ থেকে অবলীলাক্রমে আপনার লাগেজ বের করে দিচ্ছেন নিজেই।
শুধু তাই নয়, স্টপেজ এলে চিৎকার করে স্টপেজের নাম বলে যাত্রীদের সচেতন করেও দিচ্ছেন তিনি।
আপনি হয়তো নতুন। কোথায় নামবেন নাম জানেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না। আপনার গন্তব্য এসে গেছেন কিনা। আবার ভাষা সমস্যায় বুঝতে পারছেন না।
সমস্যা নেই ড্রাইভার সাহেব জানেন কে কতোদূরের টিকিট কেটেছে। আপনি চুপ করে বসে থাকলেও ঠিক আপনার সামনে এসে তুলে দেবে। না আছে খুচরো পয়সা নিয়ে গোলমাল। না আছে বাস ইচ্ছে করে দাঁড় করিয়ে রাখা নিয়ে যাত্রী –চালকের পরিচিত তর্কাতর্কি। আর বাসে দাঁড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগই নেই।
বাস চলতে চলতে চোখে ধরা পড়লো একটা নতুন জিনিস। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বাস চলছে। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট জনপদ। জানলাম এদেশে এগুলোর পরিচিত নাম ‘সিটি’।
ভোর পেরিয়ে তখন সকাল। কিন্তু লোকজনের বিশেষ দেখা নেই। মালয়েশিয়ার সময়ের সঙ্গে ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম তখনও ৭টা বাজেনি। এই ‘সিটি’ গুলো আসলে ছোট ছোট গ্রামীণ অঞ্চল। তবে বাসে যেতে যেতে যা চোখে পড়লো, তাতে বুঝলাম এই সিটিগুলো যথেষ্ট উন্নত।
কিছুটা এগোবার পর বাড়তে লাগলো লোকজনের সংখ্যা। রাস্তায় বেরোচ্ছে সাধারণ মানুষ। বুঝলাম মালয়েশিয়ায় ব্যস্ততা শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে।
জনসংখ্যার ঘনত্ব কম সেটা বোঝা যাচ্ছে। আর সেই কারণে হয়তো নিয়মকানুন এখানে সঠিক ভাবে পালন করা হয়।
‘দাদা টিকিটটা করে নিন’- বলে কলকাতায় বারেবারে কন্ডাক্টরের পরিচিত তাগাদা নেই। বাসে উঠলেই ড্রাইভারের কাছে গিয়ে টিকিট কিনে সিটে বসাটাই এখানকার মানুষদের অভ্যাস।
কেউ কেউ বাসস্ট্যান্ড থেকেই টিকিট কিনে উঠছেন বাসে, উঠে একটি অংশ চালককে দিয়ে দিলেই হবে।
এরই মধ্যেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জালান পুডু এসে গেল বাস। নেমে পড়লাম বাস থেকে। হাসি মুখে বিদায় জানালেন চালক। নামার সময় খাকি পোশাকের সঙ্গে মাথার টুপিটি এক মুহূর্তের জন্য তুললেন তার শেষ সম্ভাষণে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
ভিএস/এমএ