মালয়েশিয়া থেকে: রাত তখন ২টা। রাতের বুক চিরে চোখের সামনে দিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল দুটি মোটরসাইকেল।
প্রতিটি শহরেই রাত ধরা দেয় এক ভিন্ন চেহারায়। সে কলকাতা হোক বা ঢাকা কিংবা কুয়ালালামপুর। গভীর রাতে জেগে ওঠে শহরের ভিতর অন্য এক শহর। যা দিনের আলোয়, কর্মব্যস্ততায় খালি চোখে ধরা পড়ে না। গভীর রাতে প্রতিটি শহর হয়ে ওঠে আবরণ ও আভরণহীন। মায়াবী রাতে উঠে আসে এমন অনেক সত্য যা দিনের সকালের ব্যস্ততা বা সন্ধ্যের আলো ঝলমলে পরিবেশে চাপা পড়ে যায়।
রাতের কুয়ালালামপুর দেখতে পথে নেমেছিলাম। খুঁজতে নেমেছিলাম রাতের সত্য। যে সত্যি দিনের আলোয় পর্যটকের মাপা সীমানার মধ্যে ঘুরে বেড়ালে কোনোভাবে চোখে পড়ে না। হতাশ করলো না কুয়ালালামপুর। বিদেশি সত্যান্বেষীর চোখের সামনে তুলে ধরলো একের পর এক চিত্রকল্প যা চোখে না দেখলে স্বপ্ন বলে ভ্রম হতে পারে।
একের পর এক বাইক যখন চোখের সামনে দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তখন আমার হাত টেনে কিছুটা আড়ালে সরিয়ে নিলেন আমার সঙ্গী। এরা ‘গ্যাং স্টার’। এরাই নাকি রাতের কুয়ালালামপুর দাপিয়ে বেড়ায়। রাতের নিয়ন্ত্রক দুরন্ত গতির এই বাইক আরোহীরা। লাল-সবুজ আলোর সিগন্যাল মানামানির কোনো ব্যাপার নেই। দুরন্ত গতিতে একে অন্যের সঙ্গে বাইকে পাল্লা দিচ্ছে।
১০-১২ জনের একেকটি দল। প্রতি দলে একজন নেতা। প্রায় সবাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায়। এক দলের সঙ্গে অন্যদল প্রায়ই পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া লাগায়। তবে বিদেশি টুরিস্ট বা সাধারণ মানুষদের অসুবিধা করে না। যদি না তার মধ্যে কেউ মাথা গলায়। তবে কুয়ালালামপুরে বাইক দাপট শুধু রাতে নয় দিনের বেলাতেও আছে। তফাৎ শুধু গ্যাং স্টার পালটে যায় আম আদমিতে। তখনও লাল-সবুজ সিগন্যালের আলোকে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভঙ্গি!
মধ্যরাতে কুয়ালালামপুরে বাস চোখে পড়লো না। কিছু ট্যাক্সি পাওয়া যায়। সারাদিন বাস চলে। সরকারি বাস বিনে পয়সায় সার্ভিস সঙ্গে আবার ফ্রি ওয়াইফাই।
যদি কেউ রাস্তা না চেনে ট্যাক্সি চালকদের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যায় এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বেশি অর্থ নেওয়া। তা দিনে হোক বা রাতে। এর থেকে বাঁচতে মোবাইলে জিপিআরএস চালিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠা উচিত।
ঠিক করেছিলাম রাতে পায়ে হেঁটে যতটা সম্ভব রাতের শহর দেখবো। সঙ্গী দুই সহকর্মী ও এক ছাত্র।
ফুটপাত দিনের বেলায় মানুষ চলাচলের জন্য হলেও রাতে তা চলে যায় উদ্বাস্তুদের দখলে। জায়গায় জায়গায় শুয়ে আছে মানুষ। কেউ ফুটপাতের উপরে কাপড় বা প্লাস্টিক পেতে, কেউ বা পরিপাটি বিছানা করে গভীর ঘুমে মগ্ন। খুব কাছ থেকে ছবি তুললেও তাদের ঘুম ভাঙে না।
জানতে পারলাম আই কার্ড বা পাসপোর্ট সব সময় সঙ্গে রাখতে হয়। সে ওখানকার নাগরিক হোক বা বিদেশিই হোক। পরিচয়পত্র না দেখাতে পারলে রেহাই নেই পুলিশের হাত থেকে। কোনো কথা শোনে না বা শুনতে চায় না।
একজন তামিল মালয় নাগরিকের জানতে চাইলাম এখুনি যদি আমার পরিচয়পত্র হারিয়ে যায় কী হবে? দু’ ঠোটের মাঝে সুখটান দিয়ে ম্যাথু সুভ্রমনিয়াম বললেন, ‘নো মার্সি’।
মানে কী? কোনো ক্ষমা নেই!
‘একটা উপায় আছে- টাকা। পাসপোর্টের মতো টাকা হারাবেন না। তাহলে আর কোনো উপায় নেই। ’
হাসি পেল। দুর্নীতির চরিত্র কি দেশ-কাল-সীমা পেরিয়ে সব জায়গাতেই এক?
ম্যাথু বললো, করাপশনে ভরে গেছে দেশটা।
একই অভিযোগ শুনতে পেলাম ছাত্রত্বের ভিসা এবং শ্রমিক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষদের মুখেও। অভিযোগের আঙুল একদিকে যেমন মালয়েশিয়ার প্রশাসনের দিকে, অন্যদিকে বাংলাদেশের হাই কমিশনের দিকেও। এখানে যারা পড়ালেখা ও কর্মসংস্থানের জন্য আসেন তারা যখন পুলিশি সমস্যায় পড়লে হাইকমিশন নাকি যথেষ্ট সহযোগিতা করে না।
এমন ক্ষোভ জানালেন রাজিউল খোকন, শফিক রহমান, সাইদুল ইসলামদের মতো অনেক ছাত্ররা। তারা বলেন, ‘আমারা তো বৈধতা নিয়ে এদেশে ঢুকেছি। তবে কেন লাঞ্ছনার শিকার হবো? আর আমার দেশের হাইকমিশন দেখছি দেখছি বলে কাটিয়ে দেয়। ’
তবে বিপদে পড়া ছাত্ররা না কি পাশে পায় দু‘একটা সংগঠনকে। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, মালয়েশিয়ায় যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে আসেন তারা খুব বেশি শিক্ষিত নয়, ফলে পুলিশ একটু ভয় দেখালেই তারা টাকা খরচ করে নিস্তার পেতে চান।
গভীর রাতে চোখে পড়লো হাসপাতাল। ইচ্ছে করেই ভিতরে ঢুকে একটু ঘুরে দেখা। কর্মচারীরা আছে। কিন্তু রোগীদের তেমন দেখা নেই। এটা বেশ একটা অবাক করার মতোই দৃশ্য।
মালয়দের দাবি দূষণ কম থাকায় নাকি এখানে মানুষ সাধারণভাবে সুস্থ। হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা মনিরুল বললেন, ‘সত্যি দাদা পাঁচ বছর আছি সামান্য একবার দু’বার জ্বরের ওষুধ খেতে হয়েছিল। তবে ডাক্তার দেখাতে হয়নি। ’
কলকাতার মতো চোখে পড়ে না পথে কোন স্থায়ী টয়লেট। যা কলকাতার প্রতি দু কিলোমিটার অন্তর অন্তর আছে। কলকাতার মতো সরকারি বা বেসরকারি পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও চোখে পড়লো না।
তাহলে কিনে পানি কে খাবে?
বাঙলা টাকায় এক লিটার পেট্রলের দাম ৩৫। যা রিঙ্গিতে ১.৬০। তেলে ভর্তুকি দিতে পারে। পানিতে নয়। তেল সবার প্রয়োজন নয়, কিন্তু পানি? এক লিটার পানির দাম ২ রিঙ্গিত। অথচ সিঙ্গাপুরের মূল পানির বিক্রেতা মালয়েশিয়া। এটাই অর্থনীতি। ভুল শুধরে দিল মনিরুল, ‘এটাই ব্যবসা, পানি নিয়ে ব্যবসা’।
বাণিজ্যে মাস্টার্স করা ছাত্র সিরাজ জানালো, তেলে ভর্তুকি থাকলেও ঋণ নিয়ে শোধ করতে না পারা মানুষদের ক্ষেত্রে কোনো ভর্তুকি নেই। ‘ইজি মানি’ শেষ করছে দেশটাকে। সহজে ক্রেডিট কার্ড পাওয়া যায় এদেশে। আর দেদারসে ঋণ নিয়ে শোধ করতে গিয়ে কোমর ভাঙছে আম-জনতার। আম-জনতার কোমর ভাঙাটা তো আর কোনো বিষয় নয়। যুগযুগ ধরে দেশে দেশে এটাই হয়ে আসছে।
গোপন ঋণে জর্জরিত নাকি মালয়রা। এটা নাকি একটা সামাজিক সমস্যায় পরিণত হতে চলেছে। ক্রমশ গরিব আর অর্থবানের দূরত্বটা বাড়ছে। অর্থবান আরও অর্থবান হচ্ছে আর গরিব আরও গরিব। এটা শুধু মালয়েশিয়ার একার সমস্যা নয় ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির এটাই একমাত্র সত্য, যা পৃথিবীর সব দেশেই একই রকম।
রাতের কুয়ালালামপুরের কেনাবেচা বন্ধ, তাই বন্ধ দোকানপাটও। খোলা কিছু হাতেগোনা রেস্তোরাঁ। রাত বাড়ালে ভিড় বাড়ে নাইট ক্লাব আর ডান্স বারে। ডান্স বারে রিঙ্গিত ওড়ে ঝরা পাতার মতো। কোনও নর্তকীকে কোন একজনের ভালো লাগলে তাকে যদি অন্য কারো ভালো লাগে। তাহলেই বাঁধলো ঝামেলা। পৌঁছায় নাকি হাতাহাতিতে। চলে ক্ষমতা প্রদর্শন। এ এক আদিম প্রতিযোগিতা।
মালয়েশিয়ায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি আর বেসরকারি ক্ষেত্রের খরচ প্রায় সমান। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার একটাই সুবিধা ২০ বছরের মেয়াদে শিক্ষা ঋণ পাওয়া যায়।
কথা হচ্ছিলো রাতের কুয়ালালামপুর প্রসঙ্গে। সকালের মতো যানজট সেখানে নেই। সকালের এই যানজট দেখলে ঢাকার যানজটের কথা মনে পড়ে। আর হয়তো এ কারণেই সাধারণ মানুষ কথা দিয়েও সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারে না। তবে শুধু যে যানজটই একমাত্র কারণ তা নয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখেছি সময়ের থেকে বেশ কিছুটা দেরি করে এসে পৌঁছায় মালয়েশিয়াবাসী বা প্রবাসীরা। এটা বোধহয় তাদের সামাজিক একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
ইচ্ছে ছিল ‘গ্যাং স্টার’ দলগুলির সঙ্গে কথা বলা। তা আর হলো না। ততক্ষণে রাতও তার শেষ প্রহরে পৌঁছেছে। কিন্তু অবাক করলো তার পরতে পরতে বৈচিত্র্য। একদিকে দুরন্ত বেগে ছুটে চলা বাইক অন্যদিকে ঘুমন্ত শহর। একদিকে বিরাট অট্টালিকা ঠিক তার নিচে ফুটপাতে ঘুমন্ত মানুষ। এই বৈপরীত্যই বোধহয় বাস্তব এবং চিরসত্য। কুয়ালালামপুরের রাত সেই সত্যিই আবার সামনে নিয়ে এলো।
মালয়েশিয়া প্রশাসনের দাবি কুয়ালালামপুর আধুনিকতার মডেল হতে চলেছে অন্যান্য দেশের কাছে। প্রশ্ন একটাই প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতো ঝলমলে আলোর নিচে ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষরাও সেই আধুনিকতার সঙ্গী হবে তো!
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
ভিএস/এমজেএফ/