কুয়ালালামপুর থেকে: দুই ছাত্রীর একজন কিছু কথা বললেন বটে, কিন্তু বাধ সাধলেন ছবি তোলায়। অপরজনের তো কথা বলতেই ভীষণ অনীহা।
প্রথম জন ফিজিওথেরাপি, দ্বিতীয়জন মেডিসিনের ছাত্রী। তারা দু’জনই বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী। তবে বাবার কর্মক্ষেত্র আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে এসেছেন প্রথমজন। দ্বিতীয় জন থাইল্যান্ড থেকে। তাই বাংলাদেশি হয়েও বাংলা ভাষাতেই অকপটে নিজেদের ফেলে দিচ্ছেন বিদেশি শিক্ষার্থীদের দলে।
দিনে দিনে শিক্ষার শহর হয়ে ওঠা মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তবে এরা কেউই সরাসরি বাংলাদেশ থেকে এখানে আসেননি।
সহপাঠীদের অভিযোগ, এখানে পড়তে এসে যারা বাংলাদেশি হয়েও বাংলাদেশের পরিচয় দিতে চান না তাদের অধিকাংশই হয় মধ্যপ্রাচ্য, নয়তো থাইল্যান্ড ঘুরে এসেছেন। লাল-সবুজের বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টের পরিচয়টা লুকিয়ে রাখতে চান তারা। এমন মানসিকতা মানা যায় না।
এতে অন্যদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে যে সম্মান বাড়ে তা নয়, বরং নিজেদের কমিউনিটিতে সম্মান খোয়া যায় তাদের।
মালয়ান অ্যালাইড হেলথ সায়েন্স একাডেমির (এমএএইচএসএ বা মাহসা) ওই দুই ছাত্রীর আচরণে তাই লজ্জিত ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই আরো অনেক বাংলাদেশি।
তাদের আচরণের কথা বাদ দিলে মুগ্ধ হওয়ার মতো অনেকই কিছুই আছে মাহসা’র এই ক্যাম্পাসটায়। অনেক পরিপাটি, সুন্দর করে সাজানো। পরতে পরতে যত্ন আর শৃঙ্খলার ছাপ।
মাঝখানে প্রশস্ত এক বাঁধানো চত্বর ঘিরে গোটা পাঁচেক বহুতল ভবন। মধ্যখানে দু’তলা ভবনের ছাদে সুইমিং পুল। প্রতিটি ভবনের একটি করে সিঁড়ি নেমে এসেছে এই ছাদ চত্বরে।
সুইমিং পুলের নীল জলে শেষ বিকেলে সাঁতার কাটছেন ক’জন শিক্ষার্থী। আরো ক’জন শিক্ষার্থী পানিতে পা ডুবিয়ে বসে নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মত্ত।
পূর্ব পাড়ে ফুলের বাগানে চেনা-অচেনা ফুল। ওপাশে আরো কিছু আড্ডা জমেছে বটে। পশ্চিম দিকে রিডিং রুমে বসেছে পড়াশোনার আসর। পাশেই খেলাঘরে হরেক খেলায় মত্ত শিক্ষার্থীরা। তারও ওপাশে শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত জিমে মিউজিকের তালে তালে চলছে শরীর চর্চা।
আরো উপরের তলায় লাইব্রেরিতে সারি সারি কম্পিউটারের পেছনে অধ্যয়নে নিমগ্ন নানা দেশের শিক্ষার্থী। নিচতলার ক্যান্টিনে ভারতীয়, মালয়ী, চাইনিজ, এমনকি আরবি খাবারের পৃথক কিচেন আর কাউন্টার। শুধু ড্রিংকসের জন্য পৃথক একটি কাউন্টারও আছে এখানে। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও কোনো বাংলাদেশি খাবারের কাউন্টার চোখে পড়লো না বিশালায়তন ক্যান্টিন কক্ষে।
ক্যান্টিনের এক মাথায় মেগাশপ স্টাইলের গ্রোসারি। এখান থেকেই সব সংগ্রহ করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। এর উল্টোদিকে একটু সামনে ড্রাই-ওয়াশ কক্ষে সারি সারি মেশিনে পরিষ্কার হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাপড়।
বাইরে গেটের কাছে খোলা জায়গায় আর একটি ক্যান্টিন আছে উঁচু চত্বরে।
বেসরকারি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন আয়োজনে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। বাংলাদেশে এমন ক্যাম্পাস কবে হবে কে জানে?
স্বাস্থ্যসেবায় বৈপ্লবিক কিছু করার প্রত্যয়ে কুয়ালালামপুরের পুসাত বন্দর দামানসারায় ৬০ একর আয়তন নিয়ে এই মাহসার জন্ম ২০০৫ সালে। পরে ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে জায়গা কিনে নিয়ে জালান ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠে এর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। বর্তমানে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসটাই হয়ে উঠেছে প্রধান ক্যাম্পাস। এর পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমে ইউনিভার্সিটি অব মালয়া। দক্ষিণে পেটালিং জায়া সিটি।
মাহসা মূলত অধ্যাপক ড. দাকুক মোহাম্মদ হানিফা’র মানস সন্তান। বর্তমানে তিনি এর উপ-উপাচার্য ও নির্বাহী চেয়ারম্যান।
মেডিসিনের ক্রিনিক্যাল প্র্যাকটিশনার ড. হানিফা মেডিসিন, ডেন্টিস্ট্রি, ফার্মেসি, নার্সিং ও অ্যালাইড হেলথ সায়েন্সে দক্ষ প্রফেশনাল তৈরির প্রত্যয়ে এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ডিপ্লোমা, ডিগ্রি, মাস্টার্স ও ডক্টরাল ডিগ্রির সুবিধা নিয়ে মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্যসেবায় প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউট হয়ে উঠেছে মাহসা।
২০০৯ সালে এটি কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি কলেজের মর্যাদা পেয়েছে। বর্তমানে বিজনেস, অ্যাকাউন্টিং আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোর্সও চালু করেছে মাহসা।
জালান ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে রয়েছে ৩শ’ ছাত্র-ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা। সিঙ্গেল, ডাবল ও ট্রিপল সুবিধার রুমে রয়েছে এসি ও নন-এসি উভয় ব্যবস্থাই।
এই ক্যাম্পাস থেকে মাত্র ৫ মিনিট ড্রাইভের দূরত্বে কোটা ধামানসারায় এবং মিনিট দশেক দূরত্বের ব্রিকফিল্ডসহ একাধিক স্থানে রয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবস্থা। যাতায়াতে বাস আছে কর্তৃপক্ষের।
এই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে পাসপোর্টে ১৬ মাস মেয়াদ থাকতে হবে বাংলাদেশি ছাত্রদের। তারা ভর্তি হবে বিদেশি ছাত্র হিসেবে। প্রথমে স্টুডেন্ট পাস দেওয়া হবে এক বছরের। এখানকার ছাত্র হলে পরে বাড়ানো হবে পাসের মেয়াদ। মাহসাতে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা অন্য কোথাও পড়তে পারবেন না।
আর মালয়েশিয়া সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, ৭ দিনের বেশি সেমিস্টার বিরতি থাকলে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা উপার্জনমূলক কাজ করতে পারবেন এখানকার শিক্ষার্থীরা। টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া, বই-পুস্তক, স্টেশনারি, ভ্রমণ, স্বাস্থ্যসেবা, ইনস্যুরেন্স, ভিসা নবায়ন সব মিলিয়ে মাসে ১২শ’ রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা) ১৮শ’ রিঙ্গিত খরচ হবে মাহসাতে পড়তে এলে।
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল
বাংলাদেশ সময়: ২১০৬ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৬
আইএ/জেডএম