কুয়ালালামপুর থেকে: হেলথ ট্যুরিজমের স্বর্গ হয়ে উঠেছে মালয়েশিয়া। আকাশ ভ্রমণের বাড়তি খরচ, মাত্রাতিরিক্ত স্বাস্থ্যসেবা ফি আর দীর্ঘ অপেক্ষমান তালিকার কারণে উন্নত দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যাশীদের একটা বিশাল অংশ।
এখন আর কেবল চিকিৎসার জন্য কোথাও গিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকতে চাইছে না কেউ। বরং বেড়াতে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার দিকে দিন দিন ঝুঁকে পড়ছে মানুষ। তারা চাইছে কোথাও বেড়াতে গিয়ে স্বাস্থ্যটা পরীক্ষা করিয়ে নিতে। সঙ্গে পরিবারের জন্য একটু কেনাকাটাও সেরে নিতে চাইছে। রোগীর অ্যাটেনডেন্টদের জন্যও প্রয়োজন হচ্ছে সময়োযোগী বিনোদনের। আর এসব সুবিধা অবারিত থাকায় মালয়েশিয়া হয়ে উঠছে ভ্রমণপ্রেমী স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের অন্যতম প্রধান গন্তব্য।
মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি চিকিৎসক প্রফেসর ড. জেড হক এর মতে, মানুষের ঘোরার নেশা বাড়ছে। ঘুরতে এসে ট্রিটমেন্ট নিতে চাইছে মানুষ। সেই প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মেলাতে এখানে এথন অনেক হাসপাতাল ঘুরতে আসা মানুষের চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছে। সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক কম খরচে চিকিৎসা হচ্ছে এখানে। মানেরও কোনো পার্থক্য চোখে পড়ছে না।
আর এক বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সাব্বির চৌধুরী বলেন, মানুষ এখন কেবল হাসপাতাল পছন্দ করে না। চিকিৎসার জন্য এসে একটু কেনাকাটা করতে চায়, মুভি দেখতে চায়। রোগীর অ্যাটেনডেন্টদের জন্যও এখন এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
কার্যত মেডিকেল ট্যুরিজমের সার্বিক বিবেচনায় এশিয়ার আর সব দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া। বৈচিত্র্যময় দেশটির হাজারো আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট, সাধ্যের নাগালে থাকা হোটেল ভাড়া আর কম খরচে খাওয়ার পাশাপাশি অবারিত শপিং এর সুযোগ টেনে আনছে তাবৎ বিশ্বের পর্যটকদের।
পশ্চিমা দেশে প্রবেশের অনুমতির পাওয়ার হ্যাপাও মালয়েশিয়ার প্রতি মেডিকেল ট্যুরিস্টদের ঝুঁকে পড়ার একটা বড় কারণ হয়ে উঠেছে।
বাড়তি হিসেবে তারা পাচ্ছেন ইংরেজি বলিয়ে স্টাফ-স্কলারসহ বহুভাষা জানা দোভাষী। সহজেই তিন মাসের ভিসা পাওয়াও একটা বড় কারণ মালয়েশিয়ায় আসার।
সব মিলিয়ে তাই প্রতিদিনই ফুলেফেঁপে উঠছে মালয়েশিয়ার মেডিক্যাল ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি।
ক্যান্সার, হার্ট, অস্থিস্থাপনের মতো সার্জারি আর দাঁতের চিকিৎসা থেকে শুরু করে হেন চিকিৎসা নেই যা মালয়েশিয়ায় হচ্ছে না। আর এখানে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত থাকছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা। হেলথ চেকআপও এখন তুলনামূলক সস্তায় হচ্ছে মালয়েশিয়ায়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ খরচ বাংলাদেশের চেয়েও কম।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো- সিঙ্গাপুরের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ খরচেই বিভিন্ন চিকিৎসা নেওয়া যায় মালয়েমিয়া। যুক্তরাজ্যে কোনো চিকিৎসার জন্য যদি ৩৫ হাজার ডলার (১ ডলারে ৮০ টাকা) খরচ হয়, তাহলে মালয়েশিয়ায় খরচ হবে এর অর্ধেক। যদি কউ এখানে থেকে চিকিৎসার ফাঁকে ল্যাঙ্কাবির মতো দ্বীপ ঘুরতে চায়, ৫ তারকা হোটেলে থাকতে চায়, তাহলেও যুক্তেরাষ্ট্রের ৩৫ হাজার ডলারের তুলনায় অন্তত ১০ হাজার ডলার খরচ কম হবে মালয় উপদ্বীপে।
সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর ভারতকে হটিয়ে তাই এখন মালয়েশিয়াই হয়ে উঠছে হেলথ ট্যুরিজমের সবচে’ বড় হাব। এমনকি ওই সব দেশ থেকেও এখন রোগী আসছে মালয়েশিয়ায়। প্রতিদিনেই বাড়ছে আরবী ছাড়া আর কোনো ভাষা না জানা মধ্যপ্রাচ্যের রোগী। সিঙ্গাপুরের বিমা কোম্পানিগুলো তো তাদের ক্লায়েন্টদের মালয়েশিয়াতেই পাঠাচ্ছে তুলনামূলক কম খরচে চিকিৎসা সেবার সুযোগ নিতে।
বিশেষ করে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ মালাক্কা প্রণালী তীরের মালাক্কা আর পেনাং রাজ্য বেশি টানছে মেডিকেল ট্যুরিস্টদের।
যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ যৌথ কমিশন অব ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) এর বিচারেও কুয়ালালামপুর ও পেনাং এর হাসপাতালগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেরা।
পেনাং এর কিছু হাসপাতালে প্রায় সব রোগেরই বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে। রয়েছে ডাচ, নরওয়েজিয়ান, সুইডিশ, রাশিয়ান ও ইংরেজিসহ অন্তত ২২ ভাষা বলিয়ে স্টাফ। মানস্মত মেডিকেল ট্রাভেল কোম্পানিও গড়ে উঠেছে অনেক।
এছাড়া সারা বিশ্ব থেকেই আকাশ পথে আসা যাচ্ছে কুয়ালালামপুর ও পেনাংয়ে। এ দুই শহরেই রয়েছে তুলনামূলক কম খরচের আবাসিক হোটেলের আধিক্য। গণ-পরিবহন ব্যাবস্থা তো ঈর্ষণীয় উন্নতি করেছে। সঙ্গে মিশেছে আন্তরিক ও মনোযোগী সেবার খ্যাতি। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়া ও পেনাং হয়ে উঠেছে এশিয়ার সেরা মেডিকেল ট্যুরিজম হাব।
সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র থেকেও রোগী ছুটছে এক ঋতুর দেশ মালয়েশিয়ায়।
প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মালয়েশিয়া আসছে চিকিৎসা নিতে। যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসব এনে উন্নত বিশ্বের মেডিকেল ট্যুরিস্টদেরও ধরতে চাইছে মালয়েশিয়া।
২০১১ সালে ৬ লক্ষ ৪১ হাজার, ২০১২ সালে ৭ লক্ষ ২৮ হাজার ৮০০, ২০১৩ সালে ৮ লক্ষ ৮১ হাজার রোগী এসেছে মালয়েশিয়ায়। ২০১৫ সালে তা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।
যদিও বিদেশি রোগীর এই পরিসংখ্যান কেবল মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিল (এমএইচটিসি) এর কাছে রক্ষিত বিদেশি পাসপোর্টে আসা রোগীর। এর সঙ্গে যোগ হবে প্রবাসী, অভিবাসী, বাণিজ্য পরিব্রাজক ও ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে চিকিৎসা নেওয়া মানুষের মিছিল।
মেডিকের ট্যুরিজম থেকে ২০০৮ সালে ২৯৯ মিলিয়ন রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা)রাজস্ব আয় করে মালয়েশিয়া। ২০১১ তে রাজস্ব পায় ৫১১ মিলিয়ন রিঙ্গিত। ২০১৩ সালে তা আরো বেড়ে ৬৮৩ মিলিয়ন রিঙ্গিতে পৌছে। গত বছর এই আয় হাজার মিলিয়ন রিঙ্গিত ছাড়িয়ে যায়।
২০২০ সালের মধ্যে মেডিকেল ট্যুরিজম থেকে ৯.৬ বিলিয়ন রিঙ্গিত আয় করতে চায় মালয়েশিয়া।
নব্বই দশকের এশীয় অর্থনৈতিক মন্দার কাটিয়ে উঠতেই মুলত মেডিকেল ট্যুরিজমরে দিকে ঝুঁকে পড়ে মালয়েশিয়া। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে গঠিত হয় ন্যাশনাল কমিটি ফর দ্য প্রমোশন অব মেডিকেল অ্যান্ড হেলথ ট্যুরিজম (এনসিপিএমএইচটি)। ফলশ্রুতিতে বেসরকারি হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউট জানতুন নেগারার মতো সরকার নিয়ন্ত্রিত করপোরেট চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান পেনাং, মালাক্কা, সেলানগর, সারওয়াক ও জোহরে মেডিকেল ট্যুরিজমে মনোযোগী হয়। কাজ শুরু করে রাজ্য সরকার ও বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে মিলে।
মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য, পর্যটন এবং বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় মেডিকেল ট্যুরিজমকে প্রমোট করতে শুরু করে ২০০৯ সালে। এনসিপিএমএইচটি এর বদলে মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিল (এমএইচটিসি) গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মেডিকেল ট্যুরিজমে আকর্ষণ বাড়াতে মালয়েশিয়া সরকারের বিনিয়োগ শুল্ক ভাতা চালু হয।
বর্ধিষ্ণু এই খাতের জন্য প্রয়োজন হবে আরো সাড়ে ৫ হাজার মেডিকেল প্রফেশনাল। হাসপাতাল অবকাঠামোয় বিনিয়োগ হবে আরো ৩৩৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত।
ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল ট্রাভেল জার্নালের বিবেচনায় ২০১৫ সালে ‘ডেসটিনেশন অব দ্য ইয়ার’ তকমা পাওয়া মালয়েশিয়ার পালে তাই মেডিকেল ট্যুরিজমের হাওয়া ভালোভাবেই লেগেছে।
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৬ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৬
জেডএম/