কুয়ালালামপুর থেকে: এখানে তো ভাই বাংলাদেশ থেকে এসেছি বললেই লেবার ভাবে। টানাটানি পড়ে মান-ইজ্জত নিয়ে।
মালয়েশিয়ার লিডিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার লেক গার্ডেনে এমন আক্ষেপেই শুরু হলো আড্ডাটা।
পড়ন্ত বিকেলে লেকের নিস্তরঙ্গ জলে মৃদু ঢেউ তুলছে অরবরত ঘুর্ণনরত এক চক্রের ফোয়ারা। পাড় জুড়ে ঘন সবুজ ঘাসের গলিচা। নারিকেল, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি, সফেদা, লিচু, তেজপাতা আর সাবু গাছ। এখানে ওখানে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশবন।
পশ্চিমে কমপ্লেক্স পারদানা সিসওয়ায় হেলথ ইনস্যুরেন্স, ভিসি অফিস, ভিসা ও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাপ্লিকেশন ইউনিটের সঙ্গে এন্টারপ্রেনিওর ক্লাব। গ্যালারিসহ একটা উন্মুক্ত মঞ্চও আছে ওদিকটায়। পূর্বদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি। দক্ষিণে গবেষণা মাঠের ওপাশে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, উত্তরে ইউনিভার্সিটির মূল ফটক।
লেক গার্ডেনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় নকশাখচিত শেডের নিচে আড্ডার সঙ্গী ইউনিভার্সিটি অব মালয় এ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত ফরিদপুরের মধুখালির মেয়ে শাপলা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অধ্যয়নরত খুলনার ছেলে আরমান হোসেন। আরো সঙ্গী ইউনিভার্সিটি অব মালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠা মালয়ান অ্যালাইড হেলথ সায়েন্স একাডেমিতে (মাহসা) ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া রাজশাহীর পুঠিয়ার ছেলে শরিফুল ইসলাম, মেডিসিন পড়ুয়া ঢাকার ছেলে এএম এয়ানাত অর্ক, ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র মাগুরার ছেলে সাইফ আহমেদ এবং ঢাকার ছেলে আহসানুল ইসলাম।
বিদেশে পড়তে এসে ‘বাংলাদেশের লেবারা ইমেজ’ নিয়ে নিজেদের বিব্রত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন তাদের অনেকেই।
কিন্তু সাড়ে তিনশ’ একর জায়গার ওপরে গড়ে ওঠা ইউনিভার্সিটি অব মালয় এর বিশালতা আর অবারিত সবুজ প্রকৃতির উদারতা এক সময় ভর করলো তাদের মনে।
শেষ তক ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম-লেবার নয়, বিদেশে এসে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে মুষ্টিমেয় লোক। তাদের দায় তো আার সবার ওপরে চাপানো যায় না, উচিতও নয়।
বরং একবাক্যে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে আসা বাংলাদেশি লেবারদের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হলেন তারা। বললেন, লেবাররা আমাদের অহংকার। ওরাই দেখিয়ে দিয়েছে কি করে ভাগ্য উন্নয়নে পরিবার-পরিজন ছেড়ে যোজন যোজন দূরে এসে উপার্জনের চ্যালেঞ্জটা নিতে হয়। তারা সাহসী বীর। তাদের জন্যই আজ আমরা বিদেশে পড়তে পারছি। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশ চলছে।
কার্যত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে টাউট, বাটপার আর দালাল শ্রেণি। বিদেশে এসে নিজের দেশের মানুষের সঙ্গেই প্রতারণা করছে তারা। স্টুডেন্ট ভিসায় লোক এনে কাজে পাঠাচ্ছে।
একটা বিষয়ে সবাই মোটামুটি একমত হলেন যে, মালয়েশিয়ায় এসে কোনো বাংলাদেশি তরুণ নিজেকে ‘স্টুডেন্ট’ পরিচয় দিলে তার ছাত্রত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু কেউ ‘স্টুডেন্ট ভিসা’য় এসেছি শুনলে সে যে লেবার তা নিয়ে আর সন্দেহ থাকে না।
ভরসার কথা এই যে, স্টুডেন্ট ভিসায় এসে কাজ করার সুযোগ সম্প্রতি রদ করে দিয়েছে মালয়েশিয়ান সরকার। তবুও কি চোরে আর ধর্মের কাহিনী শোনে?
এখনো স্টুডেন্ট ভিসায় এসে কাজের সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে সরলমতি বাঙালিকে এনে বিপদে ফেলছে এক শ্রেণির তথাকথিত কলেজ আর ইউনিভার্সিটি। আর এগুলোর বেশিরভাগই ধারণ করছে পশ্চিমা আর অস্ট্রেলিয়ার নাম। যেমন লিংকন, ভিক্টোরিয়া, মেলবোর্ন ইত্যাদি নামের কলেজ-ইউনিভার্সিটি আদম পাচার করছে ছাত্র ভর্তির নামে।
এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি তো রীতিমতো ছাত্র সংসদ বানিয়ে দালাল পেশাকে সাংগঠনিক রূপ দিয়ে ফেলেছে।
আড্ডার এক পর্যায়ে উদারহণ দিয়ে সবাই বললেন, এই যেমন লিংকনে মাত্র কয়েকটি ঘরের ক্যাম্পাস। সব মিলিয়ে ৩শ’ শিক্ষার্থীর জায়গা হবে কি না সন্দেহ। অথচ ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছে তারা। তাহলে এসব ছাত্র কোথায় যাচ্ছে?
অথচ, মালয়েশিয়ায় পড়তে আসা বাংলাদেশিদের রেজাল্ট ভালো। প্রায় প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ফ্যাকাল্টিতে মেধা তালিকায় ওপরে থাকছে বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীর নাম। এই মর্যাদা সমুন্নত রাখতে তাই সবাই আদম পাচার আর ভিসার দালালি বন্ধের আহ্বান জানালেন সমস্বরে।
সঙ্গে উঠলো বাংলাদেশ হাই কমিশনে ছাত্র বিষয়ক ডেটা বেস গড়ার দাবি। জানা গেলো, এখনো মূলত লেবার সংশ্লিষ্ট কাজেই ব্যস্ত হাই কমিশন। ছাত্রদের নিয়ে তাদের এখনো উল্লেযোগ্য কোনো কর্মসূচি নেই।
মান-মর্যাদার এই চুলচেরা বিশ্লেষণের মাঝে আড্ডায় উঠে এলো দেশের সঙ্গে বিদেশের পড়াশোনার তুলনামূলক আলোচনা।
এ প্রসঙ্গে সবাই একমত হলেন যে, এখানে পড়তে এলে মনের জানালা খোলে। বড় করে ভাবা যায়। চিন্তা-চেতনা আর স্বপ্নের বুননে ভর করে সৃজনশীলতার অসীমতা।
তবে খোঁজ খবর নিয়ে এখানকার পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোতে পড়তে আসা ভালো। এতে খরচ যেমন কম, তেমনি মেধা বিকাশের সুযোগও বেশি। আর পাবলিক ইউনিভার্সিতে কোনো কারণে পড়ার সুযোগ না পেলে মাহসা’র মতো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়া ভালো।
তবে পাবলিক ইউনিভার্সিটির চেয়ে খরচ অনেক বেশি প্রাইভেটে। উপরন্তু অনেক মেধাবী ছাত্র ঠিকমতো না জানার কারণে দালালের খপ্পরে পড়ে তথাকথিত ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ধরা খাচ্ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় পড়ার তুলনামূলক আলোচনায় অবশ্য দ্বিধাবিভক্তি দেখা গেলো সমবেতদের মধ্যে। তবে আলোচনা গড়িয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে উঠলো-এখনকার পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার খরচ তুলনামূলক কম। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে টেকনিক্যাল সাবজেক্ট বুঝে খরচ বাড়ে।
কিন্তু এখানকার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির অবকাঠামো, মেধা বিকাশের সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটর কোনো তুলনাই চলে না। আার থাকা-খাওয়ার খরচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও কম।
কথায় কথায় বেলা পড়ে আসে। লেকের নিস্তরঙ্গ জলে জমতে শুরু করে আঁধার। ক্যাম্পাসের বাগানের বাতিগুলো জ্বলে উঠতে থাকে একটা একটা করে। মেঘের গুরুগম্ভীর ডাক জানিয়ে দেয়, বৃষ্টি আসছে। এই এক ঋতুর দেশে বৃষ্টি তো নিত্যকারই ঘটনা।
***মেডিকেল ট্যুরিজমের পালে হাওয়া মালয়েশিয়ায়
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল
বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৬
জেডএম/