কুয়ালালামপুর থেকে: আয়ের প্রায় সব টাকা দেশে পাঠিয়ে অনিশ্চিত জীবনের মুখে পড়ছে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা। যৌথ পরিবারের বৃহত্তর দায়িত্বের টানে ভিনদেশে রাত-দিন সমানে তারা খাটছে হাড় ভাঙ্গা খাটুনি।
সেই টাকায় হচ্ছে অসুস্থ মা-বাবার চিকিৎসা। ব্যবসা জমাচ্ছে ভাই-চাচা-আত্মীয়-স্বজন। চলছে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, পরিবারের ভরণ-পোষন। কিন্তু কাজ শেষে দেশে ফিরে তারা পড়ছে বিপদে।
এদের কেউ কে্উ টাকা জমানো আর জমি কেনার মতো দূরদর্শীতার পরিচয় দিলেও অধিকাংশই ভবিষ্যতের কথা ভাবছে না।
এমনিতেই বিদেশ থেকে ফেরার পর চাকরির বয়সটা আর থাকে না। তারওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুঁজি পড়ে থাকে অন্যের কাছে। তাই বড় ধরনের অসুখ হলে বা কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে চিকিৎসার খরচ চালানোই দায় হয়ে উঠছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে চলাচলে অক্ষম বাবুলের উদারহরণ সামনে আনা যেতে পারে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিকের কাজ করে পরিবারকে সহায়তা করছিলেন বাবুল। বিয়ে দিয়েছিলেন বোনের। কিন্তু ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে জোহরবারুতে লোহা কাটার কাজ করতে গিয়ে শরীরের ৪০ শতাংশ ঝলসে যায় তার। বাংলাদেশ দূতাবাস এবং তেনেগানিতা আর কারামএশিয়াসহ আরো ক’টি এনজিও সহায়তায় দেশে ফিরেছেন বাবুল। কিন্ত এখন চিকিৎসার খরচ চালানোই অসম্ভব হয়ে উঠেছে তার পক্ষে।
যদিও এমন উদাহরণ নিজেদের ভবিষ্যত চিন্তায় নিমগ্ন করাতে পারছে না বাংলাদেশি শ্রমিকদের। এই যেমন, কচুয়ার শামীম হোসেন ১০ বছর কাজ করে মাত্র ৪৮ হাজার টাকা জমিয়েছেন নিজের কাছে। কিন্তু কতো টাকা দেশে পাঠিয়েছেন সে হিসাব আজ তার নিজেরও অজানা।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এ দেশে আসার পর প্রথম দু’মাসে পাঠাই ৭০ হাজার টাকা। তারপর থেকে আয় বুঝে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দেশে পাঠাচ্ছি। ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা নিজের কাছে রাখছি খরচের জন্য।
লক্ষ্মীপুরের রামগতির ফারুক হোসেন বলেন, ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে দেশে আসার পর ৯ বছর বাড়ি যাই নাই। বউ ফেলে এসেছি। দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। তাদের বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে বাবার কথা। ছেলে দু’টা তাই আমার ছবি নিয়ে স্কুলে যায়। তাদের যে বাবা আছে সেটা দেখাতে পারে।
প্রতি মাসে তবু ২০ হাজারেরও বেশি টাকা দেশে পাঠান ফারুক।
অকপটে বলেন, বাড়িতে মা আছে। ভাই-বোন আছে। বাবা অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। তাই ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করি। নিজের খরচেরটা রেখে সব টাকা পাঠিয়ে দিই। তবু তো আমার কাছে ৯ বছরে ৭০ হাজার টাকা জমেছে।
আর এক বাংলাদেশি শ্রমিক শামীম হোসেন ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছেন মালয়েশিয়ায়। প্রতি মাসে টাকা পাঠানোর গল্পটা একইরকম তারও।
১৫ বছরের কিশোর আমিরুলের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। মাত্র মাস পাঁচেক আগে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে এখন সে একটা কোম্পানিতে কাজ করে ক্লিনারের। রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্য ন্ত ক্ডিউটি করতে হয়। ছুটি পায় ১৫ দিনে একদিন। ২ জনের রুমে ৬ জন থাকে গাদাগাদি করে। তবু ১৩শ’ রিঙ্গিত বেতনের (১ রি্ঙ্গিতে ২০ টাকা) ১ হাজার রিঙ্গিতই দেশে পাঠায় সে।
শরীয়তপুরের পিতা-পুত্র ছাত্তার আর লিটনেও গল্পটাও একই রকম। দু’জনে মিলে প্রতিমাসে পাঠান ৩০ হাজার রিঙ্গিত। সব টাকা খরচ হয়ে যায় পরিবারে্। দু’কানি জমি কেনার স্বপ্নটা তাই এখনো অধরা রয়ে গেছে তাদের।
আক্ষেপ চেপে ছাত্তার বলেন, পদ্মা সেতু হচ্ছে। তাই আশপাশের এলাকার জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। জমি কেনা আর হবে না বোধ হয়।
মুন্সিগঞ্জের রাসেল আর রুবেল শেখের বক্তব্য, ঋণ করে এসেছি। আগে তো ঋণের টাকা শোধ দিতে হবে্। তারপর না হয় অন্য চিন্তা।
খেঁজ নিয়ে জানা গেলো, মালয়েশিয়া থাকতে প্রতিমাসে ৫০০ রিঙ্গিত ব্যয় হয় শ্রমিকদের। সেটা রেখে গড়ে ১ হাজার রিঙ্গিত করেই দেশে পাঠায় প্রতিজন। এরপরে সঞ্চয়টা কঠিন্ই হয়ে পড়ে বটে।
যদিও সৌদি আরব্ আর আরব আমিরাতের পর এই মালয়েশিয়াতেই শ্রম দিচ্ছে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি। সব মিলিয়ে এ সংখ্যাটা ৭/৮ লাখের কম না। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছে তারা। এ টাকা ওই অর্থবছরে মোট বৈদেশিক আয়ের ১০ শতাংশ প্রায়।
তবুও নিজের চিন্তা না করে দেশ থেকে অনেক দূরে পরিবার-পরিজনের জন্য কলুর বলদের মতো খেটে যায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা। নিজের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে ভালো রাখে পরিবার-পরিজনকে।
** মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসতে পারে বাংলাদেশ
***টিনঘেরা চৌহদ্দিতে ক্রীতদাস জীবন!
***লজ্জা নয় ওরা অহংকার
***মেডিকেল ট্যুরিজমের পালে হাওয়া মালয়েশিয়ায়
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৪ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৬
জেডএম/