পুত্রজায়া থেকে: চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে চারতলার সমান মাটির ভেতর সেঁধিয়ে পাওয়া গেলো লাইট র্যাপিড ট্রানজিট (এলআরটি) প্লাটফর্ম। স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ১.৬০ রিঙ্গিতে (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা) পাওয়া প্লাস্টিক কয়েন ছুঁয়ে দরোজা খোলার পর এই অধপতন।
কুয়ালালামপুরের রাস্তায় বাসগুলোতে যাত্রী কম থাকলেও এই এলআরটিতে গিজগিজে ভিড়। দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌছা যায় বলে এই শহরে এলআরটিতে যে জনপ্রিয় তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
হাতল ধরে দাঁড়িয়ে একটু থিতু হতে না হতেই মাটির পেট থেকে চালকহীন ট্রেন বেরিয়ে এলো কুয়ালালামপুরে মাথার ওপরে। কুয়ালালামপুরের সবচেয়ে পুরনো মার্কেট ‘সেন্ট্রাল মার্কেট’ এর স্টেশন পেসার সিনিতে আধা মিনিটের বিরতি দিয়ে একটাকে কেএল সেন্ট্রাল। মসজিদ জামেক ছাড়ার পর সাকুল্যে মিনিট পাঁচেক গেলো।
প্লাস্টিক কয়েন বক্সে ফেলে নিচে নামতেই একের পর এক বিস্ময় এসে উন্মোচিত হতে থাকলো চোখের সামনে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহা কর্মযজ্ঞের আয়োজন। ক্ল্যাং ভ্যালির বিশেষ পরিবহন এলআরটি ছাড়াও এয়ারপোর্ট গামী কেএলাইএ এক্সপ্রেস রেইল লিংক, কেএলাআইএ ট্রানজিট, র্যাপিড কেএল (পুত্রা), কেটিএম কমিউটার, কেটিএম ইন্টারসিটি এবং কেএল মনোরেইল লাইন এসে মিলেছে কেএল সেন্ট্রাল।
আছে দূরপাল্লার বিভিন্ন বাস আর ট্যাক্সি স্ট্যান্ডও। তার মানে কেউ কুয়ালালামপুরে এলে এখান থেকে দেশের যে কোনো দিকে যেতে পারবে।
আরও অবাক করা ব্যাপার হলো, এই কেএল সেন্ট্রালকে বলা হচ্ছে, বিশ্বমানের শহর। ১১.৭ বিলিয়ন রিঙ্গিতে গড়ে তোলা কেএল সেন্ট্রালে কয়েকটি ফাইভ স্টার হোটেল আর মেগা শপিং মলও চোখে পড়লো। সব মিলিয়ে এ যেনো ‘শহরের ভেতরে শহর’ এর অনন্য এক উদাহরণ।
সব কিছু এতো গোছানো যে প্রয়োজনীয় প্লাটফর্মটি খুঁজে নিতে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্টাফরাও আন্তরিক।
কেএল থেকে এয়ারপোর্টগামী বুলেট ট্রেনে পুত্রাজায়া সেন্ট্রালের ভাড়া ১৪ রিঙ্গিত। টোকেনসহ টিকিট নিয়ে ফের মাটির পেটে। সুন্দর-ছিমছাম ট্রেনটিতে যাত্রী নেই বললেই চলে।
সময় মতোই ট্রেন ছাড়লো। ভূ-গর্ভ থেকে ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। দু’পাশে ক্রমশ পেছনে সরে যেতে থাকলো বহুতল ভবন, গাছ-গাছালি, পাহাড়ের সারি, খোলা মাঠ।
মিনিট খানেকের জন্য তাসিক বন্দর সেলানটানে (টিবিএস) থেমে মাত্র ১৯ মিনিটে শেষ হলো ৩৭ কিলোমিটার পথের যাত্রা।
পুত্রাজায়া সেন্ট্রালের চারদিকে খোলা জায়গা। তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পূর্ব থেকে হাওয়া আসছে হু হু করে।
মালয়েশিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুর রহমান পুত্রার নামে এই পুত্রাজায়া নাম। সংস্কৃত ভাষায় পুত্রা অর্থ যুবরাজ অথবা পুত্রশিশু। আর জায়া অর্থ সফলতা বা জয়।
বস্তুত মালয়েশিয়ার ফেডারেল প্রশাসনিক সেন্টার পুত্রাজায়া একটি পরিকল্পিত শহর।
কুয়ালালামপুরের ওপর বাড়তি চাপ কমাতে ১৯৯৯ সালে এখানে দেশটির প্রশাসনিক কেন্দ্র সরিয়ে আনা হয়। ২০০১ সালে মালয়েশিয়ার তৃতীয় ফেডারেল টেরিটোরি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পুত্রাজায়া।
পুত্রাজায়া মূলত মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নায়ক মাহাথির মোহাম্মদের মানস সন্তান।
আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট আর সেলানগরের মাঝামাঝি এই শহর গড়েন তিনি। সেলানগরের কাছ থেকে কিনে নিয়ে মাত্র ৮শ’ একর বা ৩.২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুরু হওয়া পুত্রাজায়া এখন ৮ হাজার একর বা ৩২ বর্গকিলোমিটারের মেগা শহর।
এই শহরকে সাইবারজায়ার পাশাপাশি মালটিমিডিয়া সুপার করিডোর হিসেবে গড়া হয়। প্রযুক্তি ও প্রশাসনের সেই শহরে নেমে সেন্ট্রাল থেকে বেরিয়ে ডেল অফিসের সামনে আসতেই পুলিশ চেকপোস্ট।
মালয়েশিয়া আসার পর এই প্রথম পুলিশ চেকিং চোখে পড়লো। রাস্তার পাশে বিশাল দেশি ক’জন আফ্রিকানকে থামিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। কী কারণ জানা গেলো না। তবে কোথাও একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে জানা গেলো।
বিদেশিদের সবসময় পাসপোর্ট আর এ দেশীয়দের আইডি কার্ড রাখতে হয় সঙ্গে।
এটাই নিয়ম এদেশে। তবে এখানে কোনো অঘটন ঘটলো না। হাত ইশারায় মাইগ্র্যান্ট-৮৮ এর নির্বাহী পরিচালক আশিকুর রহমানের গাড়িটিকে এগিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র দিলো কালো পোশাকের পুত্রাজায়া পুলিশ।
এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই বললেই চলে। রাস্তায় চলাচলকারী প্রাইভেট গাড়িগুলোর বেশিরভাগই প্রোটন আর পুডু। দেশি গাড়ি চালাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে দেশপ্রেমিক মালয়েশীয়রা।
সাইবারজায়ায় লিংকারান সাইবারপয়েন্ট বারাতে হোটেল আলআরাফে আরবি খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়া গেলো ফের। এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরতে ঘুরতে সূর্যটা অস্ত গেলো সাইবারজায়ার ওপাশে।
ক্রমেই বর্ণিল হয়ে উঠলো বিশ্বের বড় বড় সব সাইবার কোম্পানির শহর সাইবারজায়া আর মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রাজায়া। হরেক রঙা আলো নিয়ে হেসে উঠলো পুত্রাজায়া ব্রিজ, কোর্ট বিল্ডিং, পার্লামেন্ট ভবন।
পুত্রাজায়া লেকের ওপরে অদ্ভূত আলোর প্রতিফলন শুরু হলো মায়াবী রূপ নিয়ে। মাঝরাতেও কোর্ট বিল্ডিংয়ের উল্টো পাশের খোলা মাঠে দল বেঁধে শরীর চর্চা করছে একদল টিনএজার।
প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রাখতে পুত্রাজায়ার ২৮ শতাংশ এলাকা সবুজের জন্য সংরক্ষিত। এ টেরিটোরির কেবল ১০ শতাংশ উপকরণ আমদানি করা হয়। অবশিষ্টগুলো তৈরি করে স্থানীয় কোম্পানি।
ফেরার পথে পুত্রাজায়া সেন্ট্রালে একজন তরুণীকে বসে থাকতে দেখা গলো প্লাটফর্মে। তার মানে এই রাতে এখান থেকে যাত্রী হলো দু’জন।
কেএল সেন্ট্রালে আসতে আসতে রাত ১২টা গড়িয়ে গেলো। বন্ধ হয়ে গেছে এলআরটি। ১০ রিঙ্গিতের ভাড়া ২০ থেকে ২৫ রিঙ্গিত হাঁকছে ট্যাক্সি। মিডনাইটে ট্যাক্সি ভাড়া দ্বিগুণ
হয়ে গেছে কুয়ালালামপুরে। এক ভাড়ার গ্র্যাব ট্যাক্সির সফটওয়ারে বোধহয় সমস্যা। নাম্বার রিকগনাইজ করতে পারছে না। এমনিতে গ্র্যাব ট্যাক্সি অ্যাপসে ঢুকলেই তো ছুটে আসে ওগুলো।
অগত্যা ১৫ রিঙ্গিতে ঠিক হলো কেএল সেন্ট্রাল থেকে পুডু সেন্ট্রালের ভাড়া।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৬ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
জেডএম/
**দেশে ফিরলেই বেকার, বিদেশের অভিজ্ঞতা বিফলে
*** দূষণে কালো হয়ে আছে কুয়ালালামপুরের জননী
***মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসতে পারে বাংলাদেশ
***টিনঘেরা চৌহদ্দিতে ক্রীতদাস জীবন!
***লজ্জা নয় ওরা অহংকার
***মেডিকেল ট্যুরিজমের পালে হাওয়া মালয়েশিয়ায়
*** বাংলাদেশি পরিচয়েই যতো লজ্জা!
***এক ঋতুর দেশে
**বাংলাদেশি আবহে জাঁকিয়ে বসেছে হোটেল মার্ক
**অন টাইমে রিজেন্টে উড়ে মালয় দ্বীপে
**মালয়েশিয়া থেকে খবর দিচ্ছেন বাংলানিউজের জাকারিয়া মণ্ডল