কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে: আগ্রহী এক কোরিয়ান আর বাংলাদেশ থেকে আসা কিছু মানুষকে ওল্ড ফোক হাউস ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন ড. জাহিদুল হক। নিচতলা থেকে দোতলা, প্রতিটি ঘর-বারান্দা, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আর আশপাশের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ সবাই।
প্রিয়জনের জন্য ২৪ ঘণ্টা সেবার অঙ্গীকার নিয়ে অনেকটা ‘বৃদ্ধাশ্রম’ এর আদলে গড়া এই সেবাকেন্দ্র’র অবস্থান আমপাঙ সেন্টার শপিং মল থেকে দক্ষিণে মাত্র দুই মিনিটের হাঁটা দূরত্বে।
মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গিয়ে যদি চিকিৎসা সেবা নিতে হয় বা ২/১ মাসের জন্য বয়স্কদের কোথাও রেখে দিতে হয় তাহলে এই হোম নি:সন্দেহে আদর্শ বাছাই। এখানে ভর্তি হলে দীর্ঘমিয়াদে আবাসিক সেবার সঙ্গে সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা নার্সিং, নিয়মিত ডাক্তারের পরীক্ষা ও ঘড়ির কাঁটা ধরে বিশেষজ্ঞ সেবা নিশ্চিত। আছে বাড়ির মতো রান্না আর বাড়ির পরিবেশে সেবার জন্য বিশেষজ্ঞ নার্স। বয়স্ক রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় সব সেবার সুব্যবস্থাই আছে এখানে।
নিউএজহোম এর উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. জাহিদুল হক মেডিকেলে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তারপর থাইল্যান্ডে ট্রেনিং নিয়ে সিঙ্গাপুরে চাকরি করেছেন বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির এই ক্যাডেট। চিকিৎসাসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য মালয়েশিয়া তো বটেই, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই আর ফিলিপাইনের বেশ কিছু সম্মানসূচক উপাধি জমেছে তার ঝুলিতে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় সমাজসেবার জন্য শপথ নিয়েছেন মার্শাল হিসেবে। বিশ্ব মানচিত্রে উদীয়মান রাষ্ট্র মন্টে ডি এগ্রেলা’র এশিয়া অঞ্চলের অ্যাম্বাসেডরও তিনি।
ওল্ড ফোক হোম এর পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এই আয়োজন শতভাগ বাণিজ্যিক নয়। এখানে ১/২ মাস কম খরচে খাকার সঙ্গে বাঙালি খাবারে ব্যবস্থা আছে। রোগী ও অ্যাটেনডেন্ট এক রুমে থাকতে পারেন।
যেহেতু বয়স্কদের গড়া সমাজেই আমরা বসবাস করছি, তাই তাদের কাছ থেকে এখনো নেওয়ার অনেক কিছু আছে বলেই মনে করেন ড. জাহিদ।
তিনি বলেন, এখানে কেউ ভর্তি হলে তাকে নিশ্চিত বাড়ির আবহে, বাংলাদেশিদের জন্য দেশের আবহে দিন কাটানোর ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।
সত্যিই বাড়ির পরিবেশ তার লাল টালি ছাওয়া ছো্ট্ট দোতলা দালানটায়। ভি-আকৃতি ভবনের বেড়ে সবুজ ঘাসের ছোট্ট লন। ভবনের চারিদিকে খোলা। প্রতিটি রুমে হাওয়ার হুটোপুটি আর আলোর গড়াগড়ি।
নিচতলায় বসার চেয়ারগুলো ফোল্ডিং। এখানে আয়েস করতে এসে কোনো রোগী ঘুমিয়ে গেলে গুটিয়ে রাখা সোফার ভাঁজ খুলে বারান্দাতেই তার আরামদায়ক শোওয়ার ব্যবস্থা। পাশে ডাইনিং টেবিল।
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠলে দোতলার বারান্দাতেও ডাইনিং টেবিল। ছোট্ট ভবনটির মাঝামাঝিতে পেছনের দিকে এমার্জেন্সি এক্সিট। জানালা খুললেই পশ্চিমে চোখে পড়ে আধুনিক মালয়েশিয়ার আউকন হয়ে ওঠা পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের জোড়া মাথা।
এই বাড়িকে কিছুতেই হাসপাতাল মনে হতে দেবেন না ড. জাহিদ। তাই প্রচলিত সাদা বিছানা একটাও নেই। সব ক’টি বেডে রঙিন নকশার বেডসিট। তবে কেউ চাইলে তাকে পেতে দেওয়ার জন্য সাদা বিছানা তুলে রেখেছে ওল্ডহোমওয়ালারা।
রাখা হয়েছে ফিলিস্তিন, মালয়, চীনা ও বাংলা খাবার রান্নায় পৃথক পারদর্শী শেফ। এদের ২ জনের হাত ততো সব ধরনের রান্নাতেই পাকা। আছে বাংলাদেশি কেয়ারটেকার।
এখানে ভর্তি হলে সময়ে সময়ে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীদের। কেউ ছিপ ফেলে মাছ ধরতে চাইলে সঙ্গে থাকেন ওল্ডহোমের নার্স- অ্যাটেনড্যান্ড। বৃদ্ধদের গান গাওয়ার ক্লাবেও রোগিদের নিয়ে যান তারা।
২৪ ঘণ্টার ডাক্তার আছেন দু’জন। আছেন ফিলিপিনি দক্ষ নার্স লিমা, সোনিয়া, সোলাইনা। এখানে প্রয়োজন অনুযায়ী রোগিদের ৩ বেলা ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয়। উপরন্তু শিগগিরই কিডনি ডায়ালাইসিকত মেশিন বসছে এখানে।
অনেকে কেমো নিতে মালয়েশিয়ায় আসেন। তাদের হয়তো ২/১ মাস থাকতে হয়। তারা নিশ্চিতে উঠে পড়তে পারেন এই ওল্ডহোমে।
প্রতি বেডের ভাড়া মাসে মাত্র ২ হাজার ৫শ’ রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ২০ টাকা)। বড় ভিআইপি রুমের ভাড়া মাসে ৪ হাজার। এ টাকায় থাকা-খাওয়া ও ঘোরাসহ সব কিছুর ব্যবস্থা। রোগীর অ্যাটেনডেন্টও যাতে সঙ্গে থাকতে পারেন তার ব্যবস্থাও আছে।
এমন এলাহি আয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। প্রায় প্রতিদিনই তাই এই হোম দেখতে আসছেন কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি।
এরই মধ্যে হোম পরিদর্শন করে গেছেন মালয়েশিয়ার ট্রান্সপোর্ট মিনিস্ট্রির অ্যাডভাইজর তানশ্রি কবির, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাতু জব্বার, প্রধানমন্ত্রীর ছেলের শ্বশুর দাতু শাহীন মির্জা।
ড. জাহিদের মতে, এটা শুধু যে ওল্ড হোম তা নয়, এখানে ইয়াংরাও থাকে। অনেক সময়ে ছেলেরা ব্যস্ত থাকে। বাবা-মাকে রেখে যায়। প্রতিবন্ধী শিশুদের এখানে রেখে যায় কর্মজীবী বাবা-মায়েরা। এটাকে নেগিটেভলি নেওয়ার কিছে নেই।
তিনি মনে করেন, কয়েকজন বয়স্ক লোক এক জায়গায় হলে গল্পগুজব করেন, দাবা খেলেন, লুডু খেলেন। তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
সাম্প্রতিক এক উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কিছু দিন আগে আমাদের এখানে ব্রেন ক্যান্সার এর এক রোগি এসেছিলেন। হাসপাতাল থেকে আর মাত্র ১৫ দিন বাঁচবেন বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাকে। সেই রোগী আরো ২ মাস এখানে কাটিয়ে শান্তিতে মৃত্যুবরণ করেন।
এই ওল্ড হোম চালু করতে লাইসেন্স নিতে হয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, ফায়ার ব্রিগেড আর লোকাল কমউনিটির। শুরুতেই এ প্লাস সিল দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এই ওল্ডহোম কেপিজে গ্রুপ, প্রিন্সকোট হাসপাতাল, গ্লেনিগেলস হাসপতাল, ট্রপিকানা মেডিকেল সেন্টার, সাইম ডারবি মেডিকেল সেন্টার ও আইজিএস (ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউট) এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানও বটে। কোয়ালিতাজ গ্রুপের শাখা হিসেব কাজ করার চুক্তি হচ্ছে শিগগিরেই। বিশ্বক্যাত ওই গ্রুপের ওল্ড হাউস নেই। নতুন করে ওল্ডহোম না খুলে এটিকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিতে আগ্রহী তারা।
২০১৫ এর ডিসেম্বরে চালুর পর মাত্র ৫ মাস বয়সেই বেশ নাম করে নিয়েছে এই ওল্ডহোম। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহিদুল হক এর সঙ্গে তার স্টাফদের সমর্কটাও বেশ বন্ধুসুলভ। তারা এক সঙ্গে খান, গল্প করেন।
ড. জাহিদের চিন্তা ছিলো, তিনি বাংলাদেশে এমন একটা ওল্ডহোম দেবেন। এখনো সুযোগ পেলে চিন্তাটা বাস্তবানের পরিকল্পনা আছে তার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৬
জেডএম/