ঢাকা: উন্নত ও স্বচ্ছল জীবনের আশায় অনেকেই পাড়ি জমান বিদেশে। কিন্তু না জেনে কিংবা দালালের প্রলোভনে বিদেশ গিয়ে হয়তো ঠাঁই হয় অন্ধকার কারাগারে, নয়তো পিষ্ট হতে হয় নির্মম অত্যাচারের যাঁতাকলে।
পড়ে পড়ে মার খেতে থাকে অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার। নির্যাতনে অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, কেউবা আবার ফেরেন লাশ হয়ে। মেলে না কোনো ক্ষতিপূরণ।
এ ধরনের নির্যাতিত-নিপীড়িত অভিবাসীদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন দেশে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি সহায়তা সংস্থা মাইগ্র্যান্ট-৮৮। বুধবার (১৫ জুন) বাংলানিউজ কার্যালয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক (ইডি) আশিকুর রহমান তাদের লক্ষ, উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মাইগ্র্যান্ট-৮৮ এর প্রকল্প পরিচালক মিনহাজুর রহমান ও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর খন্দকার হাসিবুজ্জামান।
প্রথমেই ৮৮ এর তাৎপর্য তুলে ধরে আশিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের কান্ট্রি কোড ৮৮। তাই আমাদের সংস্থার নামে ৮৮ রাখা হয়েছে। এরইমধ্যে বিশ্বের কয়েকটি দেশে কাজ শুরু করেছি আমরা। তবে সব দেশেই আমাদের টার্গেট থাকছে বিপদে পড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো। অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা ও প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সহায়তা করার ব্যাপারে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আগ্রহী করে তোলাও আমাদের লক্ষ্য।
বয়সে নবীন অর্থাৎ ২০১৫ সালে যাত্রা হলেও এরইমধ্যে মালয়েশিয়ায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি অভিবাসীকে নির্যাতনের হাত থেকে উদ্ধার করেছে মাইগ্রান্ট-৮৮। আশির দশকের শেষের দিকে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করা এই সংস্থাটির কর্মীরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা সংগ্রহ করে মানবতার উন্নয়নে এগিয়ে আসেন।
আশিকুর রহমান বলেন, ভাগ্য ফেরানোর আশায় বৈধ-অবৈধ উপায়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র. যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশিরা। তারা কঠোর পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠান। সে টাকায় হয়তো অন্ন সংস্থান হয় পরিবার-পরিজনের, চিকিৎসা হয় মা-বাবার, বিয়ে হয় বোনের। ব্যবসা-দোকান হয় ভাই-চাচাদের। কিন্তু এই টাকা পাঠানোর পেছনে যে কতো কষ্ট আর বঞ্চনার গল্প আছে, তা আমরা কেউ-ই জানি না। অনেক ক্ষেত্রে সরকারও উদাসীন। তাই শ্রমিকের কষ্ট শ্রমিকেরই থেকে যায়। তাই এসব বিষয় চিন্তা করেই মাইগ্র্যান্ট-৮৮ এর যাত্রা শুরু হয়। আশিকুর রহমান বলেন, প্রবাসে শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও কোনো কোনো দেশে দূতাবাস নির্বিকার ভূমিকা পালন করে। অথচ ভারত, ফিলিফিন্সসহ অন্যান্য দেশের সরকার এবং দূতাবাস দুঃসময়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায়। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আদায়েও কঠোর ভূমিকা রাখে।
আশিকুর রহমান বলেন, মাইগ্র্যান্ট-৮৮ বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের মর্যাদা, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে সহায়তা দিতে কাজ করছে। আমাদের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশি অভিবাসীদের অধিকার রক্ষা এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, পারিবারিক অভাব-অনটন, সচেনতার অভাবে ও দালালদের নানা প্রলোভনে পড়ে অবৈধভাবে জমি-বাড়ি বিক্রি করে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। এ ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চল উভয় এলাকার মানুষই আছেন।
এ সময় কথার হাল ধরেন মাইগ্র্যান্ট-৮৮ এর বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর খন্দকার হাসিবুজ্জামান। তিনি বলেন, কোস্টগার্ডসহ সরকারি বাহিনীর তৎপরতায় আগের চেয়ে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে মালয়েশিয়াগামী অভিবাসীর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এজন্য চাই গমন বন্ধে প্রবাসীদের জন্য একটি পলিসি, কার্যকর আইন। আর সে আইন তৈরিতে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে সরকারকে আগ্রহী করতে মাইগ্র্যান্ট-৮৮ কাজ করবে।
হাসিবুজ্জামান বলেন, অভিবাসীদের সমস্যা নিয়ে আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। তারা একটি ট্রেনিং দিয়েই কাজ শেষ করে। কিন্তু মাইগ্র্যান্ট-৮৮ বিদেশ যাওয়ার আগে কিংবা পরে এবং মর্যাদার সঙ্গে তাদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিতে কাজ করবে। খোঁজ-খবর নিয়ে কর্মীদের পরিবারের সদস্যদেরও পাশে থাকবে।
প্রাথমিকভাবে মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশে অভিবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও সমতা উন্নয়নসহ বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে কাজ করছে সংস্থাটি। ঢাকা কার্যালয় রাজধানীর বারিধারায়। আর মালয়েশিয়া কার্যালয় কুয়ালালামপুরে।
সংস্থাটির প্রজেক্ট ডিরেক্টর সৈয়দ মিনহাজুর রহমান বলেন, মালয়েশিয়ায় অনেক নির্যাতিত বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। এরমধ্যে বৈধ যেমন আছেন, রয়েছেন অবৈধভাবে যাওয়া আরও অনেকে।
‘অবৈধভাবে যাওয়ার কারণে ন্যূনতম মজুরি পান অনেকে, নেই থাকা খাওয়ার ভালো কোনো ব্যবস্থা, অনেককে বিনাপারিশ্রমিকে খাটানোর পাশাপাশি চলে শারীরিক নির্যাতনও। কিন্তু কোনো কাগজপত্র না থাকায় আইনি সহায়তাও পান না তারা।
গত বছর মালয়েশিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসী শ্রমিকদের কম্বল, শুকনো খাবারসহ নগদ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছে মাইগ্র্যান্ট-৮৮। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতারণার শিকার বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রতিও।
মালয়েশিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসায় সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটছে বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির এ স্নাতক।
আলাপচারিতায় মিনহাজ বলেন, বাংলাদেশি দালালরা চাইনিজ, মালয়েশীয়দের সঙ্গে আঁতাত করে সেখানে নামে বেনামে কলেজ গড়ে তুলেছে। আর এসব কলেজে পড়ার পাশাপাশি প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা উপার্জনের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশের ছাত্রদের নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে গিয়ে তাদের না হয় পড়াশোনা, না হয় চাকরি। ফলে কষ্টের জীবন বেছে নিতে হয় তাদের।
সম্প্রতি এমনই ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীর মাহমুদুল হাসানের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। এসএসসি’তে ভালো ফল করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায়।
এক দালালের খপ্পরে পড়ে সেখানে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন তিনি। মালয়েশিয়াতেও এক বাংলাদেশি দালালের খপ্পরে পড়ে বর্তমানে জেল খাটছেন।
‘আমরা ছেলেটির সঙ্গে দেখা করে তাকে আইনি সহায়তা দিই। আগামী আগস্টে তার দেশে ফেরার কথা,’ বলেন সংস্থাটির স্বেচ্ছাসেবক ও মালয়ান অ্যালাইড হেলথ সায়েন্স একাডেমির ছাত্র শরীফুল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৪ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৬
এমএ/জেডএম