ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৬
চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে ছবি- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর

চীন সাগরের উপরে উড়তে উড়তে বছর দুই আগে হুট করে হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সেই বোয়িংয়ের কথা মনে পড়লো। ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে হারিয়ে যাওয়া ফ্লাইটটির নাম্বার ছিলো এমএইচ৩৭০। আর...

সাবাহ (বোর্নিও) থেকে: চীন সাগরের উপরে উড়তে উড়তে বছর দুই আগে হুট করে হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সেই বোয়িংয়ের কথা মনে পড়লো। ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে হারিয়ে যাওয়া ফ্লাইটটির নাম্বার ছিলো এমএইচ৩৭০।

আর এটা এমএইচ২৬২৪। সর্বশেষ নাকি দক্ষিণ চীন সাগরের এ অংশটাতেই ভাসতে দেখা গিয়েছিলো নিখোঁজ সেই বোয়িং ৭৭৭ এয়ারক্র্যাফটের তেল!

সেটি নিখোঁজ হয়েছিলো ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। এইমাত্র বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের এই এয়ারক্র্যাফটটিও ৩৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ছে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। তবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে নিচে নিকষ অন্ধকার ছাড়া কিছুই ঠাহর হলো না। মাঝরাতের কালোর আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে সাদা মেঘের দল।

প্লেনের ভেতরে আয়েসি আকাশযাত্রার পাকা আয়োজন। প্রশস্ত আসন, প্রতি আসনে হেডফোনসহ পৃথক মনিটরে পছন্দের ভিডিওতে ডুব মারার পাশাপাশি উপাদেয় খাবার এমএইচ৩৭০কে মনের আড়ালে চাপা দিতে সময় নিলো না। বাংলাদেশের ডমেস্টিক ফ্লাইট এতো আরামের কবে হবে কে জানে!

কিন্তু অবাক কাণ্ড! কুয়ালালামপুরের ডমেস্টিক টার্মিনালে প্রবেশের পর থেকে এখন পর্যন্ত একজন বাঙালিও চোখে পড়লো না। দেখতে দেখতে দক্ষিণ চীন সাগরের দেড় হাজার কিলোমিটার আকাশ পাড়ি দিলো বোয়িং ৭৩৭। ল্যান্ডিংয়ের ক’মিনিট আগে ছোট ছোট আলোর বিন্দু হয়ে ধরা দিলো চীন সাগরে ভাসমান জাহাজগুলো। তারপর রূপ নিলো খেলনা জাহাজের।

আড়াই ঘণ্টায় সতেরোশ’ কিলোমিটার উড়ে কোটাকিনাবালু আন্তর্জাতিক টার্মিনালের রানওয়ে ছুঁলো বোয়িংয়ের চাকা। মালয়েশিয়ার অংশ হলেও পাসপোর্টে আলাদা সিল পড়লো স্বায়ত্ত্বশাসিত সাবাহ সরকারের। শুরু হলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিতান্তই স্বল্প পরিচিত বোর্নিও অভিযান।

স্থানীয় ইমিগ্রেশন পার হয়ে ডিপারচার লাউঞ্জে এসেই চক্ষু চড়কগাছ। কি ইউরোপ, কি আমেরিকা বা চায়নিজ- নারী পুরুষ নির্বিশেষ গায়ে গা লাগানো চেয়ারগুলোতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এই রাতে আর গন্তব্যে যায়নি তারা। তাদের অনুকরণে বাংলার এক ছা-পোষা সাংবাদিকও ব্যাগ মাথায় দিয়ে সটান শুয়ে পড়লো পেতে রাখা চেয়ার সারিতে। এক রাতের হোটেল খরচ বেঁচে গেলো অনায়াসে।

কিন্তু একটু পর পর একটা বিড়াল ছানা কোথা থেকে এসে শরীর ঘেঁষে মিউ মিউ করতে থাকলো ভোর অবধি। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে যায় বটে, কিন্তু একটু পর ফের আসে। বিদায় বেলায় মানুষের মতো চোখ পিটপিট করে একটু কি কাঁদলো সে? না কাঁদুক, কষ্ট যে প্রকাশ করলো তা বোঝা গেলো বেশ।

এয়ারপোর্ট থেকে ৫ রিঙ্গিতে (১ রিঙ্গিতে ১৮ টাকা) সেন্টার পয়েন্টে নামিয়ে দিলো বাস। পুরো শহরটাই ঝকঝকে, তকতকে। যেনো দক্ষ শিল্পীর নিপুন হাতে আঁকা ছবি। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই। সিগন্যাল মেনেই চলছে গাড়ির বহর। চীন সাগরের তীরে প্রাতরাশের মওকায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বপুর বকগুলো।

একটু হেঁটে তামিল হোটেলে বিশাল সাইজের এক পরোটা, পেঁয়াজ-মরিচহীন ডিম ভাজি আর নাম না জানা ডালের কারি মিললো মাত্র ৫.৪০ রিঙ্গিতে। কামপাঙ আয়ারে হোটেল লা ভিভায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে সকাল ১০টা ছাড়ালো ঘড়ির কাঁটা।

কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার, কোনো বাঙালি মিললো না এয়ারপোর্টে, রাস্তায়, রেস্তোরাঁয় বা হোটেলে। অথচ তামিলরা এসে কিভাবেই না জেঁকে বসেছে এখানটায়। এ যেনো সত্যি সত্যিই এক অন্য দেশে আসা। এই বোর্নিও পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্য নাকি এখানে। এখানকার কিছু অংশে জীববৈচিত্র্যের জরিপই হয়নি এখনো। এখানকার বনের ওরাংওটাং, মাত্র ছয়/সাত ফুট উঁচু ছোট সাইজের পিগমি হাতি, হাতিশুঁড় বানর, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল ৠাফলেশিয়া, পতঙ্গভুক কলস ফুল, জলের ডুগং ইত্যাদি আরো অনেক প্রাণী ও পুষ্প প্রজাতির সুতিকাগার এই বোর্নিও।

পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু রেইন ট্রি’র বসতও এই সাবাহতে। এর অবস্থান বোর্নিও দ্বীপের পূর্ব অংশে। মালয়েশিয়া ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার একটা অংশ আছে বোর্নিও দ্বীপে। আর আছে সুলতান শাসিত ব্রুনাই। এর উত্তরে চীন সাগর, পূর্বে সুলু সাগর, দক্ষিণে সেলেব সাগর ও জাভা প্রণালী আর পশ্চিমে জাভা সাগর। এতোগুলো সাগর পৃথিবীর আর কোনো দ্বীপকেই কিন্তু ঘিরে রাখেনি।

তার চেয়েও তাজ্জব ব্যাপার, যে মালয়েশিয়াকে আমরা চিনি, সেটি হলো মালয় উপদ্বীপ। মালয়েশিয়ার মোট ৩ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে মালয় উপদ্বীপের অবস্থান মাত্র ১ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে। অবশিষ্ট ২ লক্ষ বর্গকিলোমিটারই পূর্ব মালয়েশিয়া নামে পরিচিত এই অংশটার।

কিন্তু ফেডারেল টেরিটোরি ও রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ আর পুত্রাজায়াসহ পশ্চিম মালয়েশিয়ায় প্রদেশের সংখ্যা তেরোটি। আর পূর্ব মালয়েশিয়ায় আছে ছোট্ট ফেডারেল টেরিটোরি লাবুয়ানসহ মাত্র তিনটি প্রদেশ। তার ভেতরে আবার এক সারাওয়াকই দখল করে রেখেছে সোয়া ১ লক্ষ বর্গকিলোমিটার বা বাংলাদেশের কাছাকাছি পরিমাণ ভূমি। আর সাবাহ’র আয়তন বাংলাদেশের অর্ধেক।

কয়েক দশক আগেও মানুষ শিকার করে মাথা কেটে ঘরের সামনে ঝুলিয়ে রাখতো বোর্নিও দ্বীপের আদিবাসী গোত্রগুলো। যাদের সংগ্রহে যতো বেশি মাথা থাকতো, বোঝা যেতো তারা ততোবেশি শক্তিশালী গোত্র। এখন আর তারা মানুষ শিকার করে না বলে শোনা যায়। কিন্তু এখানকার বনে একলা ঘোরা একদমই বারণ করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার। আদিবাসী গ্রামগুলোকে সাজিয়েছে পর্যটকদের উপযোগী করে।

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৬
জেডএম/   

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ