কোটা কিনাবালু (বোর্নিও) থেকে: হাত দিয়ে খেতে দেখে হেসেই কুটিকুটি মালয় মেয়েটা। আর সব মালয়ীদের মতো এর শরীরের রঙ তামাটে নয়, সাদা।
আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, তোমাদের হাসিতে মোটেও বিব্রত নই আমি। এতে বোধ হয় আরো মজা পেলো ওরা। পাশের টেবিল থেকে উঠে এসে আমার সামনে বসলো মালয় তরুণী। পরনে ঢোলা টি-শার্ট। মাথায় উল্টো করে ক্যাপ পরা। নাম তার দিদ্দ ননয়। অনবরত হাসছে। চোখভরা দুষ্টুমি তার।
বাংলাদেশের নাম শুনে কুঁচকে উঠলো কপাল। টেবিলের ওপর দু’হাতের কনুই রেখে দুই তালুতে বন্দি করলো উৎসুক মুখমণ্ডল। জানতে চাইলো, তুমি কি শিখ?
উচ্চারণটা সিক হওয়ায় শিখ শব্দটা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো আমার। ইশারায় মাথার পাগড়ি, কানের দুল আর হাতের বালার ভঙ্গি করায় বুঝলাম সে আসলে শিখ শব্দটাই বোঝাতে চাইছে।
মাথা নেড়ে বললাম, নাহ। মুসলিম। তোমার কেনো শিখ মনে হলো?
এবার পাল্টা প্রশ্ন দিদ্দ ননয়ের। তাহলে শিখরা তোমার দেশের মানুষ নয়?
নাহ, তারা ভারতের। পাঞ্জাব প্রদেশে থাকে। পাঞ্জাব শব্দটা পরিচিত তার। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, তাহলে তোমরা কি পাকিস্তানি?
নাহ, আমরা বাংলাদেশি। পাকিস্তান এক সময় আমাদের শাসন করেছে। আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে।
এবার বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে দিদ্দ গেলো ননয়ের। স্বাধীনতার জন্য এতো মানুষের জীবন দেওয়াটা বোধ হয় তার কাছে বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো, আসছি। একটু পর বয়স্ক এক মালয়ের হাত ধরে ফের হাজির দিদ্দ ননয়। পরিচয় করিয়ে বললো, আমার বাবা। তার দাদি ছিলেন শিখ। কিন্তু তারা মালয়ের মানুষ।
দিদ্দ ননয়ের বাবা ওয়াংসা ওযাং এই রেস্টুরেন্টের প্রধান শেফ। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে দেখলো আমাকে। তারপর জড়িয়ে ধরলো বুকে। আবেগে বিগলিত কণ্ঠে বললো, তুমি তো আমার ছেলের মতো দেখতে।
মোবাইল ফোনে ছেলের ছবি বের করে বললো, ওর নাম ইসমাইল। আমার ছেলে। দেখতে ঠিক তোমার মতো, নয় কি?
চেহারাটা ভালো করে দেখলাম। অনেকটা বাঙালি কাঠামো বটে, কিন্তু আমার সঙ্গে চেহারার কোনো মিলই নেই! কিন্তু সে কথা বলে এই স্নেহপাগল বুড়োকে আশাহত করার মানে হয় না। তাই তার কথায় সায় দিতে হয় হাসি মুখে।
কোটা কিনাবালুতে এখন মাঝরাত। ঘড়ির কাঁটা ২২ নভেম্বরকে বিদায় করে ঢুকে পড়েছে ২৩ নভেম্বরের ঘরে। সেন্টার পয়েন্টের সামনের রাস্তায় এখনো গাড়ির মিছিল। ছবির মতো আলো ঝলমলে রাস্তা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। চেইন ফুড শপ মায়মনা ফুড কর্নারের এই শাখাটায় এখনো গমগমে ভিড়। ২৮ ঘণ্টার খাবারের এই দোকানটায় শেফ ওয়াংসার নাইট ডিউটি। রাত ১০টা থেকে সকাল ১০টা তক কাজ করতে হবে তার। কাজ না থাকায় মেয়েও এসে বসে আছে বাবার কর্মস্থলে।
কথায় কথায় জানা গেলো, বাবা ওয়াংসার জন্ম এখান থেকে পৌনে দু’শ’ কিলোমিটার দূরে, কুদাত শহরে। ওটা অখণ্ড বোর্নিওর সর্বশেষ প্রান্ত। তারপর ফিলিপিন সাগর। আর দিদ্দ ননয়ের জন্ম সোয়াশ’ কিলোমিটার দূরে কামপাং তেমপুরাংয়ে। তবে অনেক বছর ধরেই তারা কোটা কিনাবালুর বাসিন্দা। এর আগে কখনো বাংলাদেশি দেখেনি তারা।
জন্মস্থানের কথা শুনে আরোগ্য কূপের কথা জিজ্ঞাসা করি দিদ্দ ননয়কে। চোখ কপালে তুলে বলে, সেটা আবার কি? এরপর ম্যাপ বের করে ছবি দেখাই কুয়োটার। এ কূপের পানি খেলে সব রোগ-বালাই সেরে যায় বলে বিশ্বাস করে মানুষ। এ জায়গাটা চেনো?
এবার আরো বিস্মিত হয় দিদ্দ ননয়। অবাক কণ্ঠে বলে, আমাদের জায়গা আমি চিনি না, তুমি চেনো কি করে?
প্রশ্ন শুনে গুগল সার্চ করে আরো কিছু ছবি দেখাই আরোগ্য কূপের। খানিকক্ষণ থমকে থেকে দিদ্দ ননয় বলে, আমি যাবো ওখানে। অনেক দিন ধরেই অবসাদে ভুগছি। আমার যাওয়ার দরকার আছে।
কেনো অবসাদ তোমার, কিসের এতো দুঃখ। ঝেড়ে কাশো দেখি মেয়ে!
খানিকক্ষণ থমকে থেকে আঙুলে নখ খুঁটলো দিদ্দ ননয়। চেহারাটা থমথমে। নিচু কণ্ঠে বললো, আমি আমার পুরনো হাবিকে ভুলতে চাই। অনেক দিন হলো, কোনো কাজ করতে পারি না। বেশিরভাগ সময় শুয়ে বসে কাটে। নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি রাখি। দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকে শরীরটা কেমন কুৎসিত হয়েছে দেখো?
এমন সরল স্বীকারোক্তিতে থমকে যাই আমিও। ঘড়ির কাঁটা রাত একটা পেরিয়েছে অনেক আগেই। দিদ্দ ননয়ের মুখে এখন সত্যি সত্যিই বিষাদের ছায়া।
এতোক্ষণের উচ্ছ্বলতা কোথায় যে হারিয়ে গেছে! চোখ দু’টোও আর ঝিলিক দিচ্ছে না। তার মনের ভেতর বুঝি মিথিক্যাল আরোগ্য কূপ ছাড়া এ মুহূর্তে আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৬
জেডএম/এটি