কোটা কিনাবালু (বোর্নিও) থেকে: চীন সাগরের ওপরে অমিত তেজি সূর্যের সঙ্গে বেয়াড়া মেঘদলের তুমুল যুদ্ধ চলছে। পাহাড় হয়ে মেঘদল চাপা দিতে চাইছে সূর্যটাকে।
মনে হলো যেনো গভীর গিরিখাদ ঠেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে অদম্য সূর্য রশ্মি। আর দক্ষিণ চীন সাগরের ওপরে ঝুলে থাকা আকাশটার নীল পটভূমিতে ফুটে উঠেছে বহুরূপী মেঘের আনিন্দ্যসুন্দর আলপনা।
আকাশের রূপ যে এতো মোহনীয় হয় তা চোখে না দেখলে হৃদয়াঙ্গম করা কঠিনই বটে। এটা যেনো এক ঋতুর এই দেশে ঠিক ঠিক বাংলাদেশের শরতের আকাশ। কিন্তু আমাদের শরতের আকাশ কি এর চেয়ে সুন্দর হয়!
জেসেলটন জেটির ওপরে প্রাণ জুড়ানো হু হু বাতাস। তারই কোমল পরশ ভ্রমণক্লান্ত শরীরটাকে চনমনে করে তুললো একটু সময়ের মধ্যেই। পেছনে সুনগাই হিলের বৃত্তাকার ৩৬০ ডিগ্রি অবজারভেশন টাওয়ারটা চুপটি করে বসে মজা দেখছে বুঝি। কতোগুলা বহুতল ভবন বেরসিকের মতো যেনো গোড়াগুলো চুবিয়ে রেখে আদর খাচ্ছে চীন সাগরের।
সাগরের ওপরে রেল লাইনের স্লিপারের মতো কাঠ পেতে গড়া জেটিটাকে তুলে ধরে থাকা খুঁটিগুলোও কাঠের। ওপরে কাঠের খুঁটিতে দড়ির রেলিং। ইট-সিমেন্ট আর লোহার শেকলেও ব্যবহার একেবারেই নেই এখানে।
জেটির নিচে ছলাৎছল শব্দে অনবরত মাথা খুঁটছে ভরা জোয়ার। তাতে টালমাটাল জেটি ঘিরে রাখা বয়াগুলো। নোঙর ফেলা নৌযানগুলো আয়েসে দুলছে। সাগরের বুক বেয়ে তীরের মতো ছুটে আসা স্পিডবোটগুলো আরো উত্তাল করে তুলছে জেসলটন জেটির আশপাশ।
দৃষ্টিসীমার মধ্যেই পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা টুংকু আব্দুর রহমান মেরিন পার্ক। প্রত্যেকটাই আসলে পাহাড়ি দ্বীপ। যেনো সাগর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে সবুজ শরীরগুলো। জেসেলটন জেটি থেকে খোলা সাগরে বের হতে হলে ওগুলোর ফাঁক গলেই এগুতে হবে।
একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে বর্ষাপ্রধান এই দেশে। জেটির ওপরে কাঠের পাটাতন এখনো ভেজা। কিন্তু জলভরা মেঘ নিরুদ্দেশ হওয়ায় গোধূলীর আকাশটা ফুঁটে আছে অন্যরকম এক আবহ নিয়ে।
মেরিন পার্কের পাহাড়গুলোর ওপরে যেনো ঝুলে আছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের পাহাড়। নিচে সবুজ পাহাড়ের গোড়ায় পানির বুকে খুঁটির ওপরে সারি সারি কাঁচা ঘর। এতোক্ষণ তুমুল বেয়াড়াপনা করে সূর্যটা অস্ত যেতেই আলো জ্বলে উঠলো সেগুলোতে। চীন সাগরের উত্তাল জলে সেগুলার প্রতিবিম্ব। ঢেউয়ের তালে তালে যেনো আলোর রেখাগুলো নাচছে।
সন্ধ্যা ঘনাতে সময় নিলো না বেশি। হু হু বাতাসের আদর যেনো আরো বাড়লো খানিকটা। এই সাগর নিয়ে চীন-আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ যতোই দানা বাঁধুক, এ বাতাস ওসবের থোড়াই পরোয়া করে। কোনো দেশের হয়ে এ বাতাস কখনোই বাধা পড়বে না। সাগরের উন্মত্ততা জয় করে চীনের তোলা কৃত্রিম দ্বীপ স্টার্টলি আইল্যান্ডের অবস্থান এখান থেকে উত্তর-পূর্বে।
জেটির গোড়ায় বসেছে সি-ফুডের উন্মুক্ত রেস্তোরাঁ। তাজা সিফুডের সঙ্গে সেগুলোতে পানেরও যথেষ্ট আয়োজন। বহু জাতির মানুষের বহু ভাষার কলরবে তাই মুখর জেসেলটন জেটির গোড়ার দিকটা।
পূর্ব মালয়েশিয়ার একমাত্র ফেডারেল টেরিটোরি আর সুলতান শাসিত ব্রুনাইয়ে যেতে হয় এ জেটি থেকেই। জেটির একাংশে তাই ইমিগ্রেশন অফিস। সেটা অবশ্য এখন বন্ধ। সকাল ও দুপুরে কেবল দু’টো করে এক্সপ্রেস ফেরি ছাড়ে এখান থেকে লাবুয়ান আর ব্রুনেই এর উদ্দেশে।
জেটির গোড়ায় ফেরি আর এক্সপ্রেস বোটের টিকিট কাউন্টার। টুংকু আব্দুর রহমান মেরিন পার্কে গমন প্রত্যাশীদের টিকিটও নিতে হয় এখান থেকেই। আজকের মতো সব প্যাকেজ সাঙ্গ হলেও সেগুলোতে এখন পরবর্তী দিনের ব্যস্ততা।
সঙ্গে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য সুপার শপ, কফি হাউস। একটু পরই সারারাতের বিশ্রামে যাবে জেসেলটন জেটি।
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৬
জেডএম/