সেপিলক রিভার্ভ ফরেস্ট (সান্দাকান) থেকে: কানের কাছে বিকট চিৎকারে পা পিছলে উল্টে পড়ার যোগাড়। ধুপধাড় করে ছুটে এলো ক’জন দর্শনার্থী।
একটু দূরেই একটার পর একটা গাছে ঝাঁকুনি শুরু হলো। বিশাল বপু নিয়ে কেমন অনায়াস ছন্দে গাছের শাখায় শাখায় লাফিয়ে লাফিয়ে আর একটা ওরাংওটাং এসে বসলো আগেরটার সামনে। শুরু হলো দু’জনের গলাগলি। এ এক অদ্ভূত দৃশ্য। দু’টোরই লালচে বাদামি চুল। লেজ নেই একটারও।
৪ হাজার ২৯৪ হেক্টর বিস্তৃত সংরক্ষিত এলাকার প্রবেশ মুখেই এমন দৃশ্যে তাক লেগে গেলো সবার। কানে হেডফোন লাগানো নিরাপত্তা কর্মী তখন বলছে- ইউ আর লাকি, লাকি, লাকি।
একটু পরই চার হাত পায়ে গাছের ডালে ডালে হারিয়ে গেলো ওরা। ক্যানোপি স্টাইলে বনের ভূমি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে গড়া ওয়াকওয়েটা সামনে এগিয়ে ডানে বেঁকেছে। মাথার ওপরে রেইন ফরেস্টের সবুজ ছাদ। মোড় নিতেই অদ্ভূত দৃশ্যটা চোখে পড়লো।
সামনের উঁচু গাছের গোড়ায় গড়া ফ্লাটফর্মটায় ঝুড়ি হাতে এক বন কর্মী। ছুঁড়ে দিচ্ছে কলা, ডুমুর, ডুরিয়ান, কাটা পেঁপে ইত্যাদি ফল। বিপরীতে রোমশ শরীরের বিশাল দেশি এক মানুষ বসে আয়েস করে ফল খাচ্ছে যেনো। তাকে ঘিরে বাচ্চা ওরাংওটাং আর বিভিন্ন প্রজাতির বানরের মেলা বসেছে।
একটা দুষ্টু প্রজাতির বাচ্চা ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো বিশাল বপুর হাতের পেঁপের টুকরোটা। আর একটা এগিয়ে আসতেই দাঁত খিচে একটা ধমকানি দিলো বিশাল বপু। ঠিক যেনো কোনো মেজাজি মানুষ বসে ফল খাচ্ছে।
আসলেই তো মানুষের জাত ভাই ওগুলো।
মালয়েশিয়ান শব্দ ওরাং মানে মানুষ। আর ইন্দোনেশিয়ার শব্দ ওটাং মানে অরণ্য। দু’য়ে মিলে অর্থ দাঁড়ায অরণ্যের মানুষ। জেনেটিক্যালি মানুষের খুব কাছের প্রজাতি এই ওরাংওটাং। মানুষের সঙ্গে এদের ডিএনএ এর মিল ৯৪.৪ শতাংশ। বুনো জন্তুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে মায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে এরা।
বন কর্মী ঝুড়ি উল্টিয়ে বিদায় নিতেই এক এক করে ভাগতে থাকলো বানরের দল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শূন্য হয়ে পড়া প্লাটফর্মটায় একটা কালো কাঠবিড়ালি এলো দড়ি বেয়ে। আর এলো তাগাদা নিয়ে বন কর্মী। আপাতত ভেতরে থাকার সময় শেষ।
এখন আর কোনো ওরাংওটাং বা বানর দেখা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে দূর থেকে ভেসে আসছে বিকট চিৎকার।
এদের প্রিয় খাদ্য ডুমুর। আরো খায় গাছের ফুল, ফল, কচি পাতা, নরম বাকল। তাই বলে এদের নিরামিষাশী ভাবার কারণ নেই। পাখির ডিম আর কীটপতঙ্গও দারুণ পছন্দ তাদের। মাছ ধরে খায় অগভীর জলাশয় থেকে। অদ্ভূত কৌশলে ভেঙে খায় বাদাম জাতীয় ফল। ছাড়ে না মধু পেলেও।
পুরুষগুলোর গড় ওজন ৭৫ কেজি। স্ত্রী ওরাংওটাং এর গড় ওজন ৪০ কেজির নিচে। পুরুষদের উচ্চতা হয় সাড়ে চার ফুট, স্ত্রীদের ৪ ফুটের নিচে। অর্ধশত বছরেরও বেশী আয়ু পায় একেকটা ওরাংওটাং।
এখন ফলের মৌসুম নয় বলেই এতো সহজে দর্শন মিলেছে তাদের। ফলের মৌসুমে নিজের খাবার নিজেই যোগাড় করে ওরা। আসে না বিনে পয়সার খাবার খেতে। আবার ফলের মৌসুম না হলেই যে আসে তাও নয়। রুচি বদলাতে চাইলে খাবার খোঁজে গভীর বনেই।
ওরা বাসা বাঁধে প্রতিদিনই। ডাল, লতা, পাতা দিয়ে মাঝেমধ্যেই ছাতার মতোই ছাদ বানিয়ে নেয় নিজের মতো। দিনভর জঙ্গলের লতা পাতা আর মাটিতে দাপিয়ে রাতে ঘুমায় নিজের গড়া গাছের বাসায়। ওরাংওটাং তাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৃক্ষবাসী স্তন্যপায়ী।
এই ওরাংওটাং এর বসবাস কেবল এই বোর্নিও দ্বীপেই। এদের তাই বলা হয় বোর্নিয়ান ওরাংওটাং। তাদের জাতি ভাই হিসেবে সুমাত্রান ওরাংওটাং নামে আর একটি প্রজাতি কেবল আছে পাশের দ্বীপে। এছাড়া দুনিয়ার আর কোনো বনে ওরাংওটাং নেই। শুধু তাই নয়, উল্লুক প্রজাতির মধ্যে গরিলা, শিম্পাঞ্জি আর বেবুন নামে আরো যে তিনটি প্রাণী পাওয়া যায় সেগুলো সবই আফ্রিকায়।
ওরাংওটাং আছে কেবল এ এলাকাতেই। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, পাম চাষের কারণে এদের সংখ্যা দিনদিন কমছেই।
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৬
জেডএম/এসএইচ