সাবাহ (বোর্নিও) থেকে: সাতটার গাড়ি সাতটাতেই ছাড়ছে। মাত্র দু’জন যাত্রী নিয়ে যথাসময়েই ঘুরছে ৩২ সিটের এসি বাসের চাকা।
পথ খোঁজা পথিককে এরা পথ দেখাচ্ছে আপনজনের মতো পরম মমতায়। প্রয়োজনে অচেনা পথিককে তুলে নিচ্ছে নিজের গাড়িতেই। ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কোথায় যেতে হবে কোন পথে। হোটেলে কম ভাড়ার সিট না থাকলে বেশি ভাড়ায় কৌশলে লোক আটকাচ্ছে না এরা।
এক হোটেলের মালিক বুঝিয়ে দিচ্ছে অন্য কোন হোটেলে আরো সস্তায় থাকা যাবে। এদের কাছে মানুষের কোনো পৃথক রঙ নেই। ভিনদেশে এসে ভিন ভাষায় মেশার জড়তা একটু মিশেই ভুলিয়ে দেয় এরা।
নিজের যা আছে তা নিয়েই খুশি থাকে এখানকার মানুষ। হাত দেয় না অপরের জিনিসে। তাই ঘরের বাইরেই পড়ে থাকে স্যান্ডেল, দামি জুতা। জুতার চুরির ধারণাটাই নেই এখানে। প্রয়োজন হয় না বাইক-সাইকেলে বাড়তি তালার। ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা হোটেলের দরজায় প্রয়োজন পড়ে না নিরাপত্তা কর্মী। পথিককে ছায়া দিতে ফুটপাতের ওপড়ে গড়ে দেয় দীর্ঘ ছাউনি।
শাক-সবজি বেশি সেদ্ধ না করার স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যেসটাও মজ্জাগত এদের। এ্কই রেস্তোরাঁয় সাজিয়ে রাখে ভারী, হালকা সব খাবার, পানীয় আর ফলমূল। অধিকাংশ দোকানেই এসি বসানো। এসি না থাকলে সব দিকেরই দেওয়াল খোলা।
বাতাসের পথ রুদ্ধ করতে নারাজ বোর্নিওবাসী। এদের দেশে খদ্দেরের নিজের হাতে খাবার তুলে নেওয়াই নিয়ম। কোনো খদ্দের না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখে রেস্তোরাঁ। তবুও রান্না হয় বেলায় বেলায়। এক বেলার খাবার আর এক বেলায় খাওয়াতে বুঝি জানেই না।
দূরপাল্লার বাসে চিপস হাতে ফেরি করে স্কার্ফ মাথার নারীরা। তারাই চালায় অধিকাংশ খাবারের হোটেল। ট্যাক্সি প্রয়োজন হলে ছুটে আসে সুন্দর মুখের নারী চালক। রাতে-বিরেতে একলা মেয়ে দেখে উত্ত্যক্তকারী ইভটিজার তো এরা চেনেই না।
রাত-বিরেতে এখানে কেউ ছুরি, চাকু, ড্যাগার ঠেকায় না। বাস স্টপে ব্যাগ নিয়ে দৌড় দেয় না টোকাই। ট্রাফিক ছাড়াই নিয়ম মেনে চলে ছোট বড়ো সব গাড়ি। কাউকে রাস্তা পার হতে দেখলে আগে বাড়ে না ড্রাইভার। এরা মানুষের কথা শোনে আগ্রহ নিয়ে। ভুল পথ দেখিয়ে দেয় না কাউকে। একজন না চিনলে ডেকে আনে আর একজনকে। অল্প সময়েই করে নেয় আপন অতিথি। অন্যের কাজ কারবার নিয়ে মোটেও মাথা ব্যথা নেই এদের। ব্যস্ত থাকে নিজের কাজ নিয়ে। শেখেনি অপরের কাজে বাগড়া দিতে।
পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে সদা সচেষ্ট বোর্নিওবাসী। ময়লা ফেলে না যেখানে সেখানে। বাড়ির মতো রাস্তাঘাটও রাখে চকচকে, পরিচ্ছন্ন। এরা পাহাড়ে সিঁড়ি বানায় পাহাড় না কেটেই। সরু কাঠের খুঁটির ওপর বাসায় কাঠেরই পাত। বনের মধ্যে ট্রেইল তৈরি করে তৃণলতা না কেটে কাঠের পাটাতনে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইকো ট্যুরিজমের পাইওনিয়ার তো এরাই।
এদের দেশে এলে বাংলাদেশিদের তাই লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। মালয়েশিয়া যে ১৫ লক্ষ বাংলাদেশি কর্মী আনার চুক্তি করেছে সেওতো এখানকার জন্যই। ২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পূর্ব মালয়েশিয়ার নির্মাণ, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ আর গ্যাস খাতে এরা কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তি। কিন্তু কুয়ালালামপুরে কিছু টাউট বাংলাদেশির কর্মকাণ্ড শংকায় ফেলেছে তাদের। বহিরাগত জাতির সংস্পর্শে নিজেদের চরিত্র হারানোর ভয় ঢুকেছে মনে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাই মন কষাকষি চলছে সাবাহ আর সারওয়াক সরকারের।
বাংলাদেশের উচিত হবে বিষয়টাকে আরো গুরুত্ব দেওয়া। আলাপ আলোচনা চালিয়ে ১৫ লক্ষ বাংলাদেশি পাঠানোর থেমে থাকা প্রক্রিয়া যতো দ্রুত চালু করা যায় ততোই মঙ্গল। এই বোর্নিওবাসীর কাছে আসলেই অনেক কিছু শেখার আছে বাংলাদেশের। অপরকে সম্মান কী করে করতে হয়, কী করে নিজের কাজে ডুব দিতে হয়, কেমন আচরণ আর মানসিকতা লাগে আদর্শ সামাজিক মানুষ হতে তা শিখতে হলে বাংলাদেশিদেরে এই বোর্নিওতে তো আসতেই হবে।
আরও পড়ুন..
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৬
জেডএম/