কোটা কিনাবালু (বোর্নিও) থেকে: বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রের মিলিত সুরে মাতোয়ারা গুমোট বাতাস। কিন্তু সেই সুরের সমঝদার বুঝি কেবল তিন অবুঝ শিশু।
ছোট ছোট আদুরে কুকুরছানাগুলোর খাঁচায় সাঁটিয়ে রাখা ট্যাগ বলছে ১৩৫ রিঙ্গিতে (১ রিঙ্গিতে ১৯ টাকা) বিকোবে একেকটা। সাদা পায়রার দাম ২৫ রিঙ্গিত করে। ১০ রিঙ্গিতে মিলছে একেকটা খরগোশের ছানা। ছোট ছোট অ্যাকুরিয়াম ছাড়াও পলি ব্যাগে ভরে চলছে জিয়ল মাছের জমজমাট বিকিকিনি।
শো পিস ছাড়াও নারী-পুরুষের কাপড়, জুতা-মোজার অবাধ যোগান দেখা গেলো। চোখে পড়লো নানা ধরনের সবজি আর ফলের সমাহার।
সেই সাত সকালে ত্রিপলের ছাতা সাজিয়ে পসরা বিছিয়ে বসেছে দোকানিরা। বিকিকিনি চলবে দুপুর ১টা অবধি। সপ্তাহের প্রতি রোববার এভাবেই চলছে শত বছর ধরে। তাই সানডে মার্কেট নামেই পরিচিতি এর।
সিগনাল হিল, জেসেলটন পয়েন্ট আর সিটি কাউন্সিলের বেড়ে গড়ে ওঠা এই গায়া স্ট্রিটে অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যরা বসত গেড়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। সানডে মার্কেটের ইতিহাস তারও অর্ধশত বছর আগের। এখন তৃতীয় প্রজন্মে পা রেখেছে ব্যবসা। দাদা বা বাপের ব্যবসা টানছে তাদেরই উত্তরাধিকাররা।
হেন জিনিস নেই যা এ বাজারে বিক্রি হচ্ছে না। পশু-পাখির বিকিকিনি হলে খাদ্যও তো দরকার হয়। তাই পশু খাদ্যের দোকান আছে প্রতিটি প্রাণী-পাখির দোকান ঘেঁষে। বোর্নিও দ্বীপে ছড়িয়ে থাকা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের পসরাও তো চোখে পড়লো অনেক আগেই।
আছে আদিবাসী ঐতিহ্যের কেঠো ব্যাঙ, মাথা শিকারীদের বিচিত্র বাঁশি। শো পিস আর খেলনার যে কতো রকমফের হতে পারে তা দেখতে হলেও এই রোববারের বাজারে আসতেই হবে।
এখানকার মতো করে আর কোথাও কি এসি মাইক্রোবাসে করে নার্সারি তুলে এনে সাজানো হয় বাজারে? আর কোনো বাজারে কি নারিকেলের খোলের ব্যাগ বিক্রি হয়? তরমুজ ফুটো করে তরমুজের মধ্যেই ব্লেন্ডারের নল ঢুকিয়ে জুস বানিয়ে খোলসহ কোথাও কি তুলে দেওয়া হয় ক্রেতাদের হাতে?
সত্যি এ এক অদ্ভূত বাজার। বোর্নিও দ্বীপের এমন কোনো ফল নেই যা বিক্রির জন্য ওঠেনি বাজারে। পেঁপে ছাড়াও আছে ডুরিয়ান, কলা, তরমুজসহ আরো নাম না জানা হরেক ফল। চকোলেটের রকমফেরে তো মাথা গুলিয়ে যাওয়ার যোগাড়। বিচিত্র আকৃতির হাতপাখাও সাজিয়ে রাখা সারি সারি। আছে ঐতিহ্যের মিশেলে ছুরি, চাকু, কোদাল।
চুলের কাঁটা, কানের দুল, হাতের বালা, মাথার ক্যাপ, কোমরের বেল্ট, পায়ের মোজা কি নেই এখানে?
বাজার বসেছে বলে গায়া স্ট্রিটের সব পথ পুরোপুরি বন্ধ। গায়া স্ট্রিটের চারপাশের রাস্তাগুলোতে তাই গিজগিজে ভিড়। যতো মানুষ বাজার ছাড়ছে আসছে তার চেয়েও বেশী। রাস্তার ওপরে গড়া সারি সারি অস্থায়ী দোকানগুলোর ফাঁকে ফাঁকে তাই মানুষ আর মানুষ।
কিন্তু কি অদ্ভূত ব্যাপার। বাংলাদেশের হাট বাজারের মতো এখানকার এই বিশাল হাটটা তো গমগম করছে না। এখানকার মানুষ তো তাহলে কম কথায় কাজ সারে।
মজার ব্যাপার হলো, সব পণ্যের গায়ে দাম লেখা ট্যাগ সাঁটানো আছে বটে, কিন্তু তাতে দরদামের রাস্তা রুদ্ধ করা হয়নি। এই বোর্নিওবাসী সব কিছুতে এক কথার মানুষ হলেও সানডে মার্কেটে দরকষাকষির সুযোগটা রেখেছে ঠিকই। দরকষাকষি জানলে তাই এটা যে কেনাকাটার স্বর্গ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৬
জেডএস/জেডএম/