সাবাহ (বোর্নিও) থেকে: গাছের গায়ে সাঁটা কলসিগুলোতে অশরীরী আবহ। উপরের বাঁশের ছাউনিও সে আবহ দূর করতে পারেনি।
রেইন ফরেস্টের উঁচু উঁচু গাছপালার পাতায় শাখায় ছাওয়া পাহাড়ি বনে এ গ্রামটা আর সব গ্রামের মতোই। তবে এখানে নীরবতাটা যেনো একটু বেশিই। পেছনের পাহাড়ি নদীতে পাথরের ওপরে জল গড়ানোর শব্দ নির্জনতাকে যেনো উস্কে দিলো আরো একটু। ওই জলের টানেই তো নদীর পাড়ে এই বসতি।
জানা গেলো, গাছের গায়ে ঝোলানো ওই কলসগুলো আসলে এক একটা মরদেহ ধারক কফিন। এ গাঁয়ের কারো মৃত্যু হলে প্রথমে বাঁশের ওপর ওই গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা হবে তাকে। তারপর ক’দিন বাদে পুরে রাখা হবে ওই কলসিতে। সঙ্গে থাকবে বুনো লতাপাতার রস। তারপর গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে এরা। অন্য কোথাও বাঁধবে পাহাড়ের ওপর বাঁশের ঘর। সাত মাস পর ফিরে এসে সমাধি দেবে মরদেহের।
অদ্ভূত রীতিতে মরদেহ সমাধি দেওয়া এই আদিবাসী গোষ্ঠীটার নাম লুনদায়েহ। এদের কাছে শক্তির প্রতীক কুমির। যুদ্ধে জেতার পর যোদ্ধারা ফিরে নাচতো গাইতো এই প্রতীকী কুমিরে পাশেই। কুমিরের সঙ্গ ছাড়া এদের বীরত্ব পাকা হয় না। তাই কুমিরের অবয়বটা আসলে তাদের বিজয় মঞ্চ।
ঝুলন্ত সমাধি আর ঢিবি করে গড়া কুমিরের পাশ দিয়ে সোজা এগোতেই এক লুনদায়েহ তরুণ বসা। আপনমনে গাছের বাকল থেকে সুতা কাটছে। সেই সুতা থেকে তৈরি করছে গায়ের জামা আর রশি। চোখের সামনে গাছের ছাল বাকলকে অভ্যস্ত হাতে পোশাকে পরিণত হতে দেখে তাজ্জব না বনে আর উপায় কি?
কাঠের গুঁড়ি বেয়ে মূল ঘরে উঠতেই লুনদায়েহ তরুণীর হাসিমাখা অভ্যর্থনা। স্লাইড করে কেটে রাখা সাদা ফলটার সঙ্গে বাংলাদেশের বিলে পাওয়া কেসুর ফলের দারুণ মিল। তবে এই তরুণী আগের দু’গাঁয়ের তরণীদের মতো উচ্ছ্বল নয়, সুন্দরও নয়। তার মুখাবয়বে বিষন্নতার সুস্পষ্ট ছাপ।
ঘরময় সাজিয়ে রাখা অস্ত্র আর গৃহস্থালী উপকরণের সঙ্গে কুমিরের দাঁত আর হাড়ও দেখা গেলো। সব কিছুতেই এদের কুমিরের উপস্থিতি চাই-ই চাই।
পেছনে পাহাড়ি নদীর পাশে বাঁশ-পাতার ছাদটা একটু তুলে রাখা। বাতাসের অবাধ প্রবাহের জন্য অনেকটা প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। তবুও এদের ঘরের ভেতরে অন্ধকার।
মূলত অন্ধকারে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসেরই তো মাশুল গুণছে এরা। কৃষিকাজ, গোচারণ, শিকার আর মাছধরায় সিদ্ধহস্ত লুনদায়েহ জনগোষ্ঠীর আসলে উন্নতির বড় কোনো অন্তরায় ছিলো না। কিন্তু নোংরা থাকতেই যেনো বেশি পছন্দ করছিলো এরা। পাঁড় মাতাল হয়ে পড়ে থাকছিলো ভাত থেকে তৈরি বুরাক নামে এক কড়া মদ খেয়ে। মদে বুঁদ থাকায় কমে যাচ্ছিলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ফলে হানা দিচ্ছিলো অসুখ, মহামারি। ১৯০৪-০৫ সালের দিকে বসন্তে তো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার হুমকিতেই পড়েছিলো লুনদায়েহরা।
সেবারের মহামারিতে উজাড় হয়ে গিয়েছিলো একের পর এক লুনদায়েহ গ্রাম। মাত্র ২০ হাজার জনসংখ্যা নিয়ে এমনিতেই এ সম্প্রদায় ছিলো বোর্নিও দ্বীপের এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। কিন্তু মহামারি তাদের সংখ্যা আরো কমিয়ে তলানীতে নামিয়ে দেয়। ২০ হাজার থেকে কমে কেবল টিকে থাকে ৩ হাজার লুনদায়েহ।
এখন অবশ্য অভ্যাস পাল্টেছে লুনদায়েহ গোষ্ঠীর। সর্বপ্রাণবাদের চর্চা ছেড়ে এখন তারা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারি। কলসির ভেতরে আর মরদেহ না রেখে কবর দিতে শিখেছে।
আরও পড়ুন
**লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী
**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৬
জেডএস/জেডএম/