ইনানাম (সাবাহ) থেকে: ছায়াঘেরা পাহাড়ি পথটা একেবারেই সুনশান। মাথা শিকারী মুরুত গাঁয়ের খোলা দরোজাটা খাঁ খাঁ করছে।
কাছে যেতেই দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার। দু’পাশের দেওয়াল ফুঁড়ে উদয় হলো দু’দুজন মুরুত যোদ্ধা। উদোম শরীরে হাতে বিষমাখা ব্লো পাইপ তাক করে আছে। গাইড বেন জানালো, এটা মাথাশিকারী মুরুতদের নিজস্ব অ্যামবুশ স্টাইল। শত্রু মিত্র না চিনে কাউকে গাঁয়ে ঢুকতে দেয় না এরা।
কথা শেষ হওয়ার আগেই এক যোদ্ধা এসে দাঁড়ালো সামনে। তারপর হুট করে সরে গেলো একপাশে। এবার সামনে আর এক নেংটি পরা যুবক। উদোম শরীর, মাথায় বিভিন্ন বুনো পাখির পালকের মুকুট। এ গাঁয়ের মুরুত প্রধান এবার সামনে।
বাম কাঁধে ডান হাত রাখলো মুরুত প্রধান। নিয়ম অনুযায়ী অভ্যাগতকেও তার বাঁ কাঁধে ডান হাত রেখে বুঝিয়ে দিতে হলো, আমরা শত্রু নই, বন্ধু। নাম, পরিচয় আর উদ্দেশ্য জেনে নিয়ে গ্রাম প্রধান সরে যেতেই ঝাড়ফুঁকের জন্য এলো নারী ওঝা। এরপর অনুমতি মিললো গাঁয়ে ঢোকার।
গাইডেড অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর হলেও এই আবহ একটানে নিয়ে গেলো বুনো অতীতে।
মুরুত নামে এই আদিবাসী গোষ্ঠীটাই বোর্নিও দ্বীপের সর্বশেষ নরমুণ্ড শিকারী জাতি। পঞ্চাশের দশকেও অন্য গোত্রের মানুষ শিকার করতো তারা। তারপর অতীব দক্ষতায় মুখাবয়ব আর চুল অবিকৃত রেখে ধড় থেকে আলাদা করে ফেলতো মাথা। টানিয়ে রাখতো গাঁয়ের সামনের বেড়ায়। যাদের যতো বেশি মাথা থাকতো, ততো বেশি শক্তিমত্তার প্রকাশ পেতো তাদের। নরমুণ্ডু না থাকলে ভাবা হতো দুর্বল গোত্র। মাথা শিকার মিশে ছিলো এদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসেও।
বিয়ের পাত্রকে অন্তত একটা মাথা শিকার করে উপহার দিতে হতো কনের পরিবারকে। তাহলে বোঝা যেতো, সে হবু বধু ও তার পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম। মাথা শিকার করতে না পারলে আজীবন একাই কাটাতে হতো তাকে। বসা হতো না বিয়ের পিঁড়িতে। এই গ্রামটাতেও প্রতীকী নরমুণ্ডু দেখা গেলো বটে, কিন্তু সেগুলো কালো কাপড়ে ঢেকে রাখা। এদের ঘরও মানে লংহাউজও এখানকার আর সব আদিবাসী গ্রামের তুলনায় মাটি থেকে অনেক উঁচু।
সামনের উন্মুক্ত চত্বরে সারি সারি বাঁশে ঝুলছে প্রাণসংহারী ব্লো পাইপ। লম্বা বাঁশের নলে ছোট ছোট বর্ষা গেঁথে আর এক মাথায় ফুঁ দিতো এরা। এক ফুঁতেই ছুটে যেতো বিষমাখা বর্ষার ফলা। নিমিষেই খতম হয়ে যেতো শত্রু। বর্ষার ফলা ছাড়াও তীর আর তলোয়ার সাজিয়ে রাখা এদের মাচান ঘরে। তবে এদের ঢালগুলো আর সব আদিবাসী গোষ্ঠীর মতো গোল নয়, লম্বা। দু’মাথা সুঁচালো। আনারস, ভূট্টা, লাউ, কলা আর সবজি সাজিয়ে রাখা ঢাল-তলোয়ারের পাশে।
ঘরের মাঝখানটায় চৌকোনা একটা প্লাটফর্ম মেঝে থেকে নিচে ঝুলিয়ে দেওয়া। এটা আসলে ওদের যুদ্ধজয়ী বীরদের উদযাপন মঞ্চ। রণাঙ্গন থেকে ফিরে ওই নিচু মাচানে দুলুনি দিয়ে উঁচু সিলিংয়ে বাঁধা একটা কাঠ ছুঁতে হতো বিজয়ীকে। এখানকার মুরুত যোদ্ধারা চোখের সামনে সেই মহড়া দেখালো বটে, কিন্তু তা ঘটে গেলো অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। চোখের সামনে লাফ দিলেও মনে হলো, একটু সময়ের জন্য শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিলো মুরুত যোদ্ধাটা। কেবল একটা তরঙ্গ ধরা পড়লো ক্যামেরায়। এরা যে কতোটা কৌশলী আর ক্ষিপ্র যোদ্ধা জাতি তা আর কারো বলে না দিলেও চলবে। পঞ্চাশের দশকেও দোর্দণ্ড প্রতাপে নরমুণ্ডু শিকার করতো মুরুতরা। ব্রিটিশ চার্টার্ড নর্থ বোর্নিও কোম্পানি সাবায় শাসন শুরুর পর তাদের কাছেও এরা ছিলো মূর্তিমান বিভীষিকা। ১৮৮৫ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত অনটোনাস অনটানোম নামে এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধার নেতৃত্বে মুরুতরা কাঁপিয়ে দিয়েছিলো ব্রিটিশ কোম্পানির ভিত। হাজারো যোদ্ধা যোগাড় করে তারা আক্রমণ করে বসেছিলো ব্রিটিশ প্রাসাদ। বন্দুক আর কামান নিয়েও মুরুতদের ব্লো পাইপের মতো আদিম অস্ত্রের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছিলো প্রশিক্ষিত ইংরেজ যোদ্ধারা। শেষ তক তাদের থামাতে ছলনার আশ্রয় নিতে হয় ইংরেজদের। শান্তি আলোচনার আহ্বান জানায় তারা মুরুতদের। অনটোনাস অনটানোম তার সঙ্গীদের নিয়ে সেই আলোচনায় আসার পথে ইংরেজদের হাতে বন্দি হন। ব্রিটিশ ছলের কাছে পরাজিত হয় অকুতোভয় মুরুত। এরপর আইন করে মুণ্ডু শিকার বন্ধ করে দেয় ইংরেজ কোম্পানি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৬
এইচএ/জেডএম/
আরও পড়ুন
** মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে
**কলসির ভেতর লুনদায়েহ কবর
**লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী
**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে