ইনানাম (বোর্নিও) থেকে: মিউজিকের তালে তালে শরীর ঝাঁকি খাচ্ছে মুণ্ডুশিকারী মুরুত যোদ্ধার। নকশাখচিত ঢাল আর খাপখোলা তলোয়ারও যেনো নাচছে।
প্রতি পদক্ষেপেই শত্রু ঘায়েলের মুদ্রা। প্রতি মুদ্রাতেই অজেয় দেহভঙ্গীর দৃপ্ত নড়াচড়া। মাথায় দুলে দুলে বীরের বার্তা দিচ্ছে পাখির পালকের মুকুট।
নাচের এ ভাষা সার্বজনীন। নিমিষে বিমোহিত করে ফেললো শত শত দর্শককে। সবাই বুঝলো, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ফিরে এসে উদ্দাম নৃত্যে মত্ত হয়েছে মুরুত যোদ্ধারা। তাদের এ নাচের অন্যতম অনুষঙ্গ যুদ্ধেরই উপকরণ রক্ষাকবচ ঢাল আর খাপখোলা তলোয়ার।
একটু পরই পর্ব পালটে গেলো নাচের মঞ্চে। যুদ্ধজয়ী মুণ্ডু শিকারীকে বরণ করতে এসেছে চার তরুণী। পরনে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। পায়ে মল। মাথায় পাখির পালকের মুকুটের সঙ্গে খোপায় ফুলও গোঁজা।
যুদ্ধে জিতে ফিরে আসা বীরকে পেছনে রেখে নাচছে তারা। ঠিক যেনে আগলে রাখছে প্রিয়জনকে। একটু পর পেছনে চলে গেলো চার তরুণী। এবার সামনে চলে এলো মুণ্ডু শিকার করে আসা মুরুত বীর। যেনো সামনেই আসার কথা ছিলো তার। আজ তো তারই দিন।
এরপর শুরু হলো যুদ্ধজয়ী বীরকে সম্মান জানানোর চূড়ান্ত নৃত্যু। দু’পাশে দু’সারি তরুণ-তরুণীর হাতে বাড়ি থেকে থাকলো বাঁশ। অদ্ভূত ছন্দ তার। যেনো হাতের বদলে বাঁশ দিয়েই তালি বাজায় এরা। আর সেই বাঁশের ফাঁকে তিন মুরুত তরুণী অপূর্ব ভঙ্গিমায় নাচছে। ভঙ্গীতে আনন্দ, যুদ্ধজয়ের বরণ বার্তা।
হঠাৎ বসে পড়লো তিন তরুণী। এবার বাঁশের ওপরে নাচতে শুরু করলো দুই যোদ্ধা। বাঁশের ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে তাদের এখনকার নাচটা আগের মতো আয়েসি নয়, বরং ক্ষ্যাপা টাইপের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো যেনো ক্ষেপতে থাকলো তারা।
দ্রুত হতে থাকলো বাঁশের তালি। মুরুত নাচিয়েদের শরীরে যেনো বিদ্যুতের ঝলকানি। বাঁশের সঙ্গে বাঁশের বাড়ি খাওয়ার শব্দকে এখন আর আলাদা করা যাচ্ছে না। যেনো তালির তরঙ্গ উঠেছে মঞ্চে। আর হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে মুরুত নাচিয়েদের পা। শরীরে তাদের স্লাইক্লোনের ঘূর্ণি। হার্টবিট বেড়ে গেছে হতবাক দর্শকদের।
মারি মারি ভিলেজের পারফরম্যান্স হলে উপস্থিত বহু ভাষা ও দেশের দর্শকরা যেনো শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। কারো চেতনাতেই এখন আর বাঁশের অবিচ্ছিন্ন তালি ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিস্ত নেই।
শূন্যে লাফিয়ে উঠে তাই দুই মুরুত যোদ্ধা যখন হাঁটু গেঁড়ে মঞ্চে বসে বাতাসে নাচ শেষের মুদ্রা আঁকলো তখন বিমুগ্ধ দর্শকরা তালি দিতেও ভুলে গেছে। কিছুক্ষণ থমকে থাকার পর সম্বিত ফিরে পেয়েই তাই শুরু হলো তুমুল করতালি।
মুণ্ডুশিকারের পর ফিরে আসা যোদ্ধাদের এখাবেই নেচে বরণ করা হতো বোর্নিও দ্বীপের মুরুত সমাজে। বিশেষ ধরনের এই বাঁশ নৃত্যের মুরুত নাম মাগুনাতিপ। উত্তর বোর্নিওর সাবাহ প্রদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাচ হলো এই বাঁশ নৃত্য। মাগুনাতিপ শব্দটি এসেছে স্থানীয় আতিপ শব্দ থেকে। যার অর্থ দুই পৃষ্ঠতলের চাপ। বাঁশের ফোকরে অদ্ভূত দক্ষতায় চা চালানোর এই কলা বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজের বাঁশনৃত্যের চেয়ে অনেক বেশী দ্রুতলয়ের। অনেকটা শিবের প্রলয় নৃত্যের সঙ্গে এর তুলনা করা যায়।
এর আগে বোর্নিও দ্বীপের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী বাজাউ নাচের আসর জমেছিলো একই মঞ্চে। তবে সেটা ছিলো সামাজিক উৎসবের নাচ। চার জোড়া তরুণ-তরুণীর সে নাচে ছিলো আয়েসি উদযাপনের নান্দনিক লয়। সেটাও উপভোগ্য ছিলো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাঁশের ফাঁদে পা ফেলে বিদ্যুতের ঘূর্ণি তোলা নাচ সব আবহকেই ছাড়িয়ে গেলো যেনো।
জায়গাটা সাবাহ প্রদেশের রাজধানী কোটা কিনাবালু থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে, ইনানামের পাহাড়ি বনে। অদ্ভূত সুন্দর ভালোলাগার তাই সাক্ষী হয়ে রইলো কেবল পাহাড়ি বন, আর মঞ্চের পাশ দিয়ে ছুটে চলা পাথুরে নদীটা।
আরও পড়ুন
**নরমুণ্ডু শিকারী মুরুত গাঁওয়ে
** মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে
**কলসির ভেতর লুনদায়েহ কবর
**লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী
**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৬
জেডএস/জেডএম/