ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

শিকারি কুমিরের সঙ্গে কোলাকুলি

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৬
শিকারি কুমিরের সঙ্গে কোলাকুলি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লাঠি দিয়ে গুঁতিয়ে কুমির দু’টোকে জাগিয়ে তুললো লোক দুটো। দুপুরের ভুড়িভোজ সেরে অর্ধেকটা শরীর পানিতে চুবিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। লাঠির গুঁতো খেয়ে একটু চোখ মেলেই পিছলে নেমে গেলো পানিতে।

লায়া লায়া (তুয়ারান) থেকে: লাঠি দিয়ে গুঁতিয়ে কুমির দু’টোকে জাগিয়ে তুললো লোক দুটো। দুপুরের ভুড়িভোজ সেরে অর্ধেকটা শরীর পানিতে চুবিয়ে ঘুমাচ্ছিলো।

লাঠির গুঁতো খেয়ে একটু চোখ মেলেই পিছলে নেমে গেলো পানিতে। কুমিরের খেলা দেখানো বুঝি লাটে উঠলো এবার।

স্বচ্ছ পানির নিচে নিশ্চল পড়ে আছে বিশাল শরীর। দু’টোই বোর্নিও দ্বীপের বিরল প্রজাতি। বড় বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী ধরে আস্ত গিলে খায়। লম্বা লাঠি দিয়ে দু’টোকেই সুড়সুড়ি দিতে শুরু করলো লোক দু’টো। ওরা জানে কোথায় ছুঁয়ে দিলে আগে বাড়তে বাধ্য হয় কুমির।

হলোও তাই। সুড়সুড় করে দুটো কুমিরই উঠে এলো ডাঙায়। একটার ঘাড়ের পেছনে মৃদু চাপ দিতেই হাঁ হয়ে গেলো মুখ। এক কর্মী বসে পড়লো তার সামনে। অপরজন কুমিরের পাগুলোকে টেনে পেছনমুখো করে দিলো। এর মানে হলো, পায়ের নিশানা পেছনে রেখে আর লাফ দিতে পারবে না কুমির। একই সঙ্গে বিশাল মুখটা হাঁ হয়েই থাকবে।
সামনের লোকটা এবার মাথা নামিয়ে চুমো খেলো কুমিরের ঠোঁটে। মনে হবে বুঝি জাদু দিয়ে পাথর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে নোনা জলের এই হিংস্র কুমিরকে। কিন্তু পুরোটাই আসলে কৌশল। পাশে দাঁড়ানো শিক্ষিকা টাইপের এক নারী তখন এমনভাবে বিষয়গুলো বর্ণনা করে যাচ্ছেন যেনো, যে কেউ জলে নেমে কেবল কৌশল করেই কুমিরকে বশে রাখতে পারবে।

ঘুম ভাঙিয়ে বেশ খানিকক্ষণ টানা হেঁচড়া শেষে ছাড়া পেয়েই ফের অর্ধেক শরীর পানিতে চুবিয়ে ঘুমিয়ে গেলো কুমির দুটো। তুয়ারান ক্রোকোডাইল ফার্মের আকাশে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। পেছনের লঙহাউজটার চাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে পানি। বৃষ্টিতে ভিজছে উটপাখি, ভোঁদড়, গন্ধগোকূল আর বানর। বিশাল অজগরটা কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে গেছে বোধ হয়।
একপাশে সারি সারি চৌবাচ্চায় কুমিরের বিভিন্ন সাইজের বাচ্চা। তারপর একটা বিশাল পুকুর জুড়ে গিজগিজ করছে নানা আকৃতির কুমির। ছুড়ে দেওয়া আস্ত মুরগি ছোঁ দিয়ে ধরে টপাটপ গিলে ফেলছে কুমিরগুলো। বোর্নিও দ্বীপের এই কুমিরগুলো ২৭ ফুট পর‌্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। সর্বোচ্চ ওজন হয় ৫ হাজার পাউন্ড। আর প্র্রত্যেকটা কুমিরই পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠতে পারে তার শরীরের সমান উচ্চতা। পুকুরের উপরে ওয়াকওয়েগুলো তাই অনেক উঁচু।

তবে সব কুমিরের কিন্তু মুরগিতে মন নেই। যাদের ক্ষুধা আছে কেবল তারাই মুরগি গিলতে এসেছে বৃষ্টিভেজা দুপুরে। কুমিরের এই এক বিশেষ গুণ। মানুষের মতো খাবার জমায় না তারা। ক্ষুধা পেলে শিকারে বের হয়। খাওয়া হয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়ে ফের। ভরা পেটে কখনোই শিকার করে না এরা। আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৭ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটায় জলের কিনারায়।

এই এখন এ পুকুরের শ’দেড়েক কুমিরের মধ্যে মুরগি খেতে এসেছে বড় জোর ডজনখানেক। বাকিরা কেউ ঘুমাচ্ছে। কেউবা অলস চোখে চেয়ে দেখছে অন্যদের মুরগি খাওয়া। প্রত্যেকটার সামনের থাবায় ৫টি করে আঙুল, পেছনেরগুলোতে ৪টি করে। জলের ভেতর নাকি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে এরা।
পেছনের পুকুরটায় পাওয়া গেলো এখানকার মহারাজাকে। পানির ভেতরে লেজের ঘাঁইয়ে নিজের শক্তির একটু নমুনা দেখালো বুঝি সে। কালচে শরীরটা আসলেই বিশাল। সুলু সাগর থেকে সম্প্রতি ধরে আনা হয়েছে এটাকে। এখনো তোই কোনো নাম দেওয়া হয়নি তার। দর্শনার্থী দেখেই কি না কে জানে, ওয়াকওয়ের নিচে সেঁধিয়ে গেলো ২ টন ওজনের শরীরটা।

এ পুকুরটাতেও খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়া কুমিরের সারি। কেউ ডাঙ্গায়, কেউ অর্ধেক শরীর পানিতে চুবিয়ে ঘুমাচ্ছে। পুকুরের মাঝখানটায় মাথা তুলে ভেসে থাকা কুমিরের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে বুঝি ভিজতে এসেছে ওরা।
এ ফার্মটার অবস্থান উত্তর বোর্নিতে, দক্ষিণ চীন সাগরের পাড়ে। সাবাহ’র রাজধানী কোটা কিনাবালু থেকে এখানে আসতে হলে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ। তবে ট্যাক্সি ভাড়া করে এলে অন্তত হাজার তিনেক টাকা বেরিয়ে যাবে পকেট থেকে। সস্তা ফর্মুলাটা হলো লোকাল বাস। প্রথমে কোটা কিনাবালুর ওয়াওয়াসান লোকাল টার্মিনাল থেকে উঠতে হবে ১২ সিটের মাইক্রোবাসে। ঘণ্টাখানেক পর তুয়ারান শহরে নেমে ভাড়া দিতে হবে মাত্র ৪ রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিতে ১৯ টাকা)। সেখান থেকে আর একটা মাইক্রোবাস ধরতে হবে কেজি লায়া লায়া রুটের। ড্রাইভারকে বললেই নামিয়ে দেবে একদম ক্রোকোডাইল ফার্মের মুখে। ভাড়া নেবে মাত্র দেড় থেকে ২ রিঙ্গিত।

আরও পড়ুন...

**আকাশের হেলান দিয়ে মসজিদ ভাসে ওই​
** প্রলয় নৃত্যে হতবাক দর্শক
**নরমুণ্ডু শিকারী মুরুত গাঁওয়ে​
** মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে
**কলসির ভেতর লুনদায়েহ কবর
**লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী​
**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে


বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৬
এমজেএফ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ