এবড়োথেবড়ো পাথুরে দেওয়ালের ফাঁক-ফোঁকরে বসানো হরেক রঙা আলোর ছটায় অতিকায় গুহা জুড়েই ঘোরলাগা মায়াবী আবহ। শেষ মাথায় খাড়া উঠে গেছে পাথুরে সিঁড়ি।
নিচের খাঁজে খাঁজে দক্ষ শিল্পীর নিপুন হাতে গড়া রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, হনুমান, রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিশ্বামিত্র, বিভীষণ প্রমুখের পরিপূর্ণ কাহিনীকাব্য। গোহা গুহাটাই যেনো রূপ নিয়েছে সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণে। এই গুহার নাম তাই রামায়ণ গুহা। কুয়ালালামপুর শহরের উপকণ্ঠে বাতু গুহা দেখতে গিয়ে এই রামায়ণ গুহা না দেখে ফিরে আসাটা গ্রেট মিসের পর্যায়েই পড়বে।
কার্যত রাম ও অয়ন শব্দ নিয়ে রামায়ণ শব্দটি তৈরি। যার অর্থ রামের যাত্রা। প্রাচীণ ভারতীয় সূর্য বংশীয় রাজাদের কাহিনী অবলম্বনে রচিত এই মহাকাব্যের রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকি। এতে মূলত অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র ও বিষ্ণুর অবতার রামের জীবনকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। সপ্তকাণ্ড বা সাত খণ্ডে বিভক্ত মহাকাব্যটিকে মহা ধুমধামেই ফুটিয়ে রাখা হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক গুহা জুড়ে।
আদিকাণ্ডে রামের জন্ম ও বাল্যজীবন, অযোধ্যা কাণ্ডে রামের নির্বাসন, অরণ্যকাণ্ডে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার বনবাস ও রাবণের সীতা অপহরণ, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে রামের মিত্রতা, সুন্দরকাণ্ডে রামের সসৈন্যে লঙ্কা গমন, লঙ্কাকাণ্ডে রাম-রাবণের যুদ্ধ, রাবণের পরাজয় ও সবংশ মৃত্যু, সীতাকে উদ্ধার ও রাবণের ভাই বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন এবং উত্তর কাণ্ডে রামচন্দ্রের সীতা বিসর্জন, লব-কুশের জন্ম, রাম-সীতার পুনর্মিলন ও মৃত্যু বর্ণিত হয়েছে।
সব মিলিয়ে, প্রাচীন ভারতের ধর্মচেতনা ফুটে উঠেছে সবিস্তারে। মহাকাব্য হলেও হিন্দুদের কাছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে রামায়ণ। ভারতবর্ষের বাইরেও যে এই রামায়ণ কতো সমাদৃত এটা তারই নজির। মালয়েশিয়া ছাড়াও শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়াতেও বেশ জনপ্রিয় রামায়ণ। এই গুহা তো তারই প্রমাণ।
এখানে দলবদ্ধ মূর্তির মাধ্যমে যেসব দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দশরথের স্ত্রী কৌশল্যার গর্ভে রাম, সুমিত্রার গর্ভে যমজ সন্তান লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন এবং কৈকেয়ীর গর্ভে ভরতের জন্ম কাহিনী। এপরপর বিশ্বামিত্রের কাছে রাম ও লক্ষণের যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা, লাঙলের রেখায় বিষ্ণুপত্নী দেবী লক্ষ্মীর অবতার জানকী বা সীতাকে কুড়িয়ে পাওয়া, সয়ম্ভর সভায় ধনুকে গুণ টেনে সীতাকে রামের জয়, কৈকেয়ীর কুপরামর্শে রামকে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে যাওয়ার আদেশ দেন ও পরে পুত্রশোকে দশরথের মৃত্যুর দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্যালারির ধারাবাহিক প্রদর্শনীতে।
আরো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে- পিতার আদেশ মেনে নিয়ে রামের বনবাসে যাওয়া, বিষ্ণুর সহচর শেষনাগের অবতার লক্ষ্মনের হাতে বোন সুপর্নখার কান কাটা পড়ার জেরে সীতাকে লংকায় রাক্ষসরাজ রাবণের অপহরণ, কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের বানর ও শিবের অবতার হনুমানের সঙ্গে রামের সখ্য ইত্যাদি দৃশ্য।
দশ হাজার বছর কঠোর সাধনা করে ব্রহ্মার কাছে বর পেয়ে তখন অপরাজেয় দশ মাথার রাক্ষস রাবণ। কোনো দেব, দানব বা ভৌতিক জীব তাকে বধ করতে পারবে না। তাই তাকে বধ করতে মানুষ রূপে জন্ম নেন বিষ্ণু। অবতার রাম হয়ে তিনি রাক্ষস রাজ্য অভিযানের প্রস্তুতি নেন।
লংকা দ্বীপে (বর্তমান শ্রীলংকা) শুরু হয় ভালো-মন্দের তুমুল লড়াই। ঢোল বাজিয়ে হুল ফুটিয়ে রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণকে ঘুম থেকে তোলা, তপোবনে রাবণের সঙ্গে সীতার কথোপকথন, রাবনের দরবারে হুনমানেরে লেজে আগুন, ভাই বিভীষণের রাবণের পক্ষ ত্যাগ করে রামের দলে যোগদান, লংকায় রাম-লক্ষ্মণ-হনুমানের চূড়ান্ত যুদ্ধযাত্রা ও যুদ্ধজয়ের ধারাবাহিক কাহিনী এতো সুন্দর করে যে ভাস্কর্যের আদলে ফুটিয়ে তোলা যায় তা এখানে না এলে বুঝে ওঠা কঠিনই বটে।
এই রামায়ণ কার্যত পৃথিবীর আদি মহাকাব্য। ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী, এ উপাখ্যানের রচনাকাল ত্রেতাযুগ হিসেবে পরিচিত পৌরাণিক সময়ে হলেও খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতককে এ মহাকাব্যের রচনাকাল ধরা হয় ঐতিহাসিকভাবে।
এতে প্রাচীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। রামায়ণের একেকটি চরিত্র যেমন, রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, বিভীষণ একেকটি আদর্শের প্রতীক। পিতৃসত্য ও প্রজা পালন, পতিপরায়ণতা, ভাতৃভক্তি ইত্যাদি গুণের কারণে চরিত্রগুলো অনন্য রূপ লাভ করেছে। ভারতীয় হিন্দু সমাজের জীবন ও সংস্কৃতিতে তাই রামায়ণের প্রভাব অপরিসীম। আর এসবকে উপজীব্য করেই আনিন্দ সুন্দর এই গ্যালারি গড়ে রামায়ণ গুহাকে রূপ দেওয়া হয়েছে কুয়ালালামপুরের অন্যতম আকর্ষণীয় এক ট্যুরিস্ট স্পটে।
কুয়ালালামপুরের যে কোনো স্থান থেকে এলআরটিতে করে কেএল সেন্ট্রালে এসে বাতু কেভগামী ট্রেনে এখানে আসা যায়। স্টেশনের পেছনেই রামায়ণ গুহা আর পাহাড়ের অবস্থান। গুহায় ঢুকতে জনপ্রতি টিকিট কাটতে হবে ৫ রিঙ্গিতে (১ রিঙ্গিতে ১৯ টাকা)।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৬
জেডএম/