জীবনটা পুরোপুরি একটি ছকের মধ্যে আটকে গেছে তাদের। প্রতিদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠেন।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে আবার একই শিডিউল। সপ্তাহিক ছুটির দিন বাজার করা ও কাপড়-চোপড় পরিষ্কারের জন্য বরাদ্দ রাখতে হয়। কুয়ালালামপুরে থাকেন কিন্তু টুইন টাওয়ার কিংবা কেএল টাওয়ার কোনোটাই দেখা হয়ে ওঠেনি এমন প্রবাসীর সংখ্যাও ঢের।
এক সময় রঙিন স্বপ্ন দেখলেও অনেকের কাছেই জীবনটা ফিকে হয়ে গেছে। নিজের জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখেন না। সন্তানদের ভবিষ্যতটা গড়ে দিয়ে যেতে পারলেই হয়। ঝিনাইদহের (কোর্টচাঁদপুর) শহিদুল ইসলাম এমনই একজন। রঙিন স্বপ্ন দেখতেন, কিন্তু এখন স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
এখন সব সময় আল্লাহ আল্লাহ করে মেয়েগুলোকে ভালো ঘর দেখে বিয়ে দেওয়া এবং ছোট ছেলেটিকে পড়ালেখা করে মানুষ করা। নিজের জীবনের শখ আহ্লাদ বলতে আর কিছুই নেই তার।
চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক শহিদুল ইসলাম। সালমা ও আসমাকে বিয়ে দিয়েছেন। মালা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, স্বপ্না পড়ে নবম শ্রেণিতে। একমাত্র পুত্র মাহিন পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। তাদের নিয়েই তার যত ভাবনা। ওদের একটি অবস্থানে তুলে দিতে পারলে মালয়েশিয়া ছাড়তে চান।
ওদের জন্যই ওভার টাইম খাটেন। অনেক কষ্টে গ্রামে বাড়িটা করতে পেরেছেন, কিন্তু কোনো পুঁজি জমাতে পারেননি। তাই প্রতিদিনই ওভারটাইম কাজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কাজ থাকে না অনেক সময়। শহিদুল ইসলাম যেখানে থাকেন তার বর্ণনা নাই বা শুনলেন। কখনও টিভি দেখেন না। দেখবেন কি করে, সেখানে যারা থাকেন তাদের কারও রুমেই টিভি নেই। টিভি হয়তো চাইলে কিনতে পারবেন। কিন্তু রাখার মতো যথেষ্ট জায়গা নেই রুমে। ছোট্ট একটি রুমে চারজন থাকেন গাদাগাদি করে।
শহিদুল ইসলামের কাছে প্রশ্ন ছিল, অবসর কাটে কি করে? উদাস ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, আমাদের আবার অবসর! কাজ করে সময় পাই না। রড টানাটানি করে ক্লান্ত থাকি। বাসায় ফিরে কোনো রকমে রান্না করে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। মাসে একদিন ফোন করে সবাই মিলে কোতারায়া আসেন। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা দেড় দু’য়েক সুখ দুঃখের গল্প করি এটাই আমাদের বিনোদন।
তাদের এই জমায়েতের দিনটা হয় সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববার। ১২ ফেব্রুয়ারিতেও কথা হয় সেই কোতারায়াতেই। যখন শহিদুল ইসলাম আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে সুখ-দুঃখের গল্প করছিলেন। বন্ধু বলতে বাল্যকালের বা পড়ার সহপাঠী কেউই নন তারা। ১৯৯৩ সালে তারা একসঙ্গে উড়াল দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। সেই থেকে বন্ধুত্ব, এখনও অটুট রয়েছে। ৩৭ জন এসেছিলেন একসঙ্গে। পনেরো জন দেশে ফিরে গেছেন। দু’জন দুনিয়ার মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। এখন ২০ জন রয়েছেন মালয়েশিয়া। মাসে একদিন কোতারায়া মিলিত হন সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার জন্য।
রোববারও (১২ ফেব্রুয়ারি) তাদের এই জমায়েতে সভাসদ মাত্র ৫ জন। এরমধ্যে ছিলেন নওগাঁর রানীনগরের আবুল কালাম আজাদ, শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জের (রামভদ্রপুর) বাবুল, কুমিল্লার শফিকুল ইসলাম। সেখানেই কথা হয় এই খেটে খাওয়া সহজ সরল মানুষগুলোর সঙ্গে। যারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।
তাদের সেই আড্ডায় কিন্তু হাসি-আনন্দ লক্ষ্যণীয় নয়। একেক জন পালা করে তার গল্প বলছেন, অন্যরা হা করে গিলছেন। কেউ কেউ অবশ্য নিজের জীবনের কিছু সংকট নিয়ে আলোচনা করছেন। মাঝে মাঝে দু’একটা পরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ।
দুপুর ১২টায় মিলিত হয়ে দেড়টা পর্যন্ত চলল তাদের এই আলাপচারিতা। এরপর শুরু হলো ফেরার পালা। কেউ কেউ পা বাড়ালেন বাজারের দিকে। কারণ যেখানে থাকেন ভালো বাজার পাওয়া যায় না। কোতারায়া থেকে সপ্তাহের বাজার নিয়ে যেতে চান।
আবুল কালাম আজাদের জীবনের লক্ষ্য কি বলতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভাই দু’জন সঙ্গী পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। আমিও একদিন চলে যাব। খানিকটা রসিকতা করে বলেন, এখানে এসে কিছুই নিয়ে যেতে পারলাম না। শুধু মাথার চুলগুলো রেখে গেলাম।
তার সেই হেয়ালির উত্তর দিলেন নিজেই। আবুল কালাম আজাদ যখন মালয়েশিয়া আসেন, তখন তার মাথায় ছিল ঝাঁকড়া চুল। এখন পুরাই টাক মাথা। সে কারণে তার জীবনের সঙ্গে এই রসিকতা।
কোতারায়া ঘুরে এর রকম বেশ কয়েকটি গ্রুপের দেখা মিললো। যারা বিভিন্ন এলাকায় থাকেন, ফোনে ফোনে কন্ট্রাক্ট করে চলে এসেছেন দেখা সাক্ষাৎ করতে। আবার কেউ এসেছেন বাঙালি ভাইদের সঙ্গে প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলার জন্য। বাংলায় কথা বলতে না পরলে নাকি দম আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তাই মাসে একদিন হাজির বুকের মধ্যে জমে থাকা কথাগুলো বলতে।
তবে এখানেও যন্ত্রণা পিছু ছাড়ে না তাদের। অনেকের ওয়ার্ক পারমিট নেই, সবসময় তীক্ষ্ণ নজর রাখেন পুলিশের প্রতি। পুলিশ দেখলেই গলি কিংবা মার্কেটের ভেতরে মিলে যান।
**প্রবাসীদের সহি আমলনামা-২
** মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের সহি আমলনামা
** বুকিত বিনতানের সম্প্রীতি
** মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের আস্থা ‘লাকম ইনন’
** বাংলানিউজের সিরাজ এখন মালয়েশিয়ায়
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
এসআই/এএ