আর শেষ ধাপে রোগী বা তার স্বজনদের চাওয়া থাকে, সেবাটা যেন সাশ্রয়ী বা সুলভ হয়, চিকিৎসা খরচই যেন বোঝা না হয়ে পড়ে।
রোগীদের প্রধান এই তিনটি চাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার গ্লেনিগেলস কুয়ালালামপুর (জিকেএল)।
সাজানো-গোছানো ও পরিপাটি কুয়ালালামপুরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জিকেএলের পথচলা ১৯৯৬ সালে। প্রথমে কেবল ব্লক এ থাকলেও গতবছর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্লক বি’র যাত্রা হয়েছে বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের রোগীর সেবাদানে অনুমোদনপ্রাপ্ত এই হাসপাতালে। ৩৩০টি শয্যা ও ১৫০ স্পেশালিস্ট কনসালট্যান্টের এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সেবার মানকে পাঁচ তারকা হোটেলের কাছাকাছি মানের বলে মনে করে কর্তৃপক্ষ।
এ নিয়েই কথা হচ্ছিলো হাসপাতালের বি ব্লকে’র কনফারেন্স কক্ষে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। জিকেএল’র মাতৃপ্রতিষ্ঠান পার্কওয়ে পানতাই’র মালয়েশিয়া অপারেশন্স ডিভিশনের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং বিভাগের ম্যানেজার সাইমন চিওকের স্বরে প্রথমেই এলো রোগীর স্বস্তি নিশ্চিত করার কথা, ‘হাসপাতাল শুনলেই রোগী ও তার স্বজনদের মনে একটা ভীতি কাজ করে, এই ছোটাছুটি-ভোগান্তি, রোগ সারাতে এসে কেবল হয়রানিতেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেকে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য রোগীর যত আরাম নিশ্চিত করা যায়। রোগী যেন তার জীবনের সেরা সময়গুলোর একটি মনে করে এই হাসপাতালে যাপিত জীবনকে। ’
চিওকের কথা মতো, সত্যিই এই কঠিন প্রত্যয় নিয়ে জিকেএল সেবা দিচ্ছে অর্থোপেডিক্স অ্যান্ড ট্রমা সার্জারি, কার্ডিওলজি, নিউরোসার্জারি, অনকোলজি, রেডিওলজি, ইউরোলজি থেকে শুরু করে অ্যালার্জি অ্যান্ড ইমিউনোলজির ক্ষেত্রেও। সেজন্য বিশাল বিশাল দুই ভবনে রয়েছে ২৪ ঘণ্টা জরুরি ও ট্রমা সেবা, কার্ডিয়াক ও নিউরো থিয়েটারসহ রয়েছে পূর্ণ সেবাদাতা অনেক থিয়েটার, হেলথ স্ক্রিনিং সেন্টার, অনকোলজি সেন্টার, গামা নাইফ সেন্টার, ফার্টিলিটি সেন্টার, নিউরো সেন্টার, ১২৮ সিটি স্ক্যানার, ১.৫ থেকে ৩.০ টেসলার এমআরআই, ইন্টারভেনশনাল রেডিওলজি প্রভৃতি সেন্টার। সেবার এই আয়োজনে জিকেএলের চিকিৎসকদের আন্তরিকতা যেন আরও বেশি। এ নিয়েই হাসপাতালে কথা হচ্ছিলো ডা. পল সেলবিন্দসের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স থেকে নানা সময়ে চিকিৎসা সেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ ও ফেলোশিপ লাভ করা ডা. পল জিকেএলে লাপারোস্কপিক সার্জারি (অ্যাপেন্ডিসাইটিস চিকিৎসার চূড়ান্ত ধাপ) ও কলোরেক্টাল সার্জারি (কোলন ও রেক্টামের ক্যানসার উপশমে) করে থাকেন। অন্য আরও কিছু ক্ষেত্রেও সার্জারির অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। চিকিৎসাখাতের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গেও নিজেকে তিনি শানিত করেন সর্বাগ্রে, জিকেএলের আর সব চিকিৎসকদের মতোই।
অস্ত্রোপচার মানেই কাটা-ছেঁড়া বা জ্বালা-যন্ত্রণা হলেও ডা. পল দাবি করেন, জিকেএল রোগীকে কম যন্ত্রণার, একইসঙ্গে দ্রুত আরোগ্য ও চলাচলে উপযোগী করে দেওয়ার সেবা দিতে চায়। মস্তিষ্কের টিউমার সারাতে জিকেএল যদি গামা-নাইফ সার্জারি করে, তবে রোগী ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চলাচল করতে পারবে। যদিও পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য রোগীর স্বার্থে একরাত রেখে দেওয়া হয় তাকে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. পল আরও বলেন, কোনো রোগী এলে তিনি চিকিৎসা নেওয়ার পর যদি মনে করেন সরাসরি যোগাযোগ করবেন আমার সঙ্গে, তবে তার কাছে আমার ফোন নম্বর এবং ইমেইল অ্যাড্রেস দিয়ে দিই। তারা যেকোনো সময়ই যোগাযোগ করলে সরাসরি সমাধান। কোনো মাধ্যমের হয়রানি নেই। সেবার এমন দিক নিয়ে আলাপ করতে করতেই পুরো হাসপাতাল ঘুরে দেখাচ্ছিলেন সাইমন চিওক। তিনি বলছিলেন, ‘এখানকার চিকিৎসক থেকে সেবিকা, সবাই উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সবাই নিবেদিতপ্রাণ হয়ে সেবা দেন রোগীদের। এই হাসপাতালে চলে আসে চিকিৎসাখাতের সবশেষ প্রযুক্তিও। ’
জিকেএল কুয়ালালামপুর শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে বলা যায়। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে রাজধানী শহরে ঢোকার পর চারদিক থেকে সবচেয়ে ভালো যোগাযোগের হাসপাতাল এটিই। আর জিকেএলের আশপাশে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রোগীরা ভিসা অন্যান্য কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান পেয়ে যান সহজেই। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি রোগীদের হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লাইট এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত প্রায় সব বুকিংয়েই সহযোগিতা করে থাকে জিকেএল কর্তৃপক্ষ। বিদেশি নাগরিকদের যেন কথা বলার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য হাসপাতালে রয়েছে কেবল ইংরেজি চর্চা।
দুরারোগ্য কোনো রোগ থেকে সুস্থতা লাভে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হলে মাথায় আসে খরচের চিন্তাটি। এক্ষেত্রে রোগীকে পুরোপুরি ‘নির্ভার’ রাখছে জিকেএল কর্তৃপক্ষ। ডা. পল এবং চিওক বলছিলেন, সিঙ্গাপুর বা অন্যান্য দেশে ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো ফি আদায় করে নেওয়ার সুযোগ পেলেও জিকেএলে তার কোনো পথ নেই। কারণ, দেশের অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের মতো জিকেএলের ব্যবস্থাপনা বা ফি আদায়-প্রদানও দেখাশোনা করে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সুতরাং এই হাসপাতালের খরচ অন্যসব হাসপাতালের মতোই।
সুলভ তথা সাশ্রয়ী মূল্যেই রোগীদের সেবা দিয়ে জিকেএল মাত্র ২১ বছরে পেয়ে গেছে বেশ কিছু সম্মাননা ও পুরস্কার। এরমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘স্বাস্থ্যসেবা শিল্পের স্বীকৃতি পুরস্কার’, ইন্টারন্যাশনাল ওয়েলনেস অ্যান্ড হেলথকেয়ার ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইডব্লিউএইচটিএ) সদস্যপদ লাভ, আমেরিকান গণমাধ্যম রিডার ডাইজেস্টের বিচারে ‘সবচেয়ে আস্থার ব্র্যান্ড পুরস্কার’ উল্লেখযোগ্য।
এই পুরস্কার সেবার উন্নয়নের মানের স্বীকৃতি দিলেও ডা. পল ও চিওকরা মনে করেন, জিকেএল স্বাস্থ্যের যত্নের নতুন অগ্রসেনানী। এই হাসপাতালে সেবা পেলে মালয়েশিয়ান হোন-বিদেশি হোন, সবার মনে হবে যে তারা স্বজনদের আদর-যত্নে সেরে উঠছেন।
হুসাইন আজাদ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর
ঈর্ষা জাগায় মালয়েশিয়া
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৭
এইচএ/