মালয়েশিয়ায় প্রথমবার এসেছি তাই গেনটিং হাইল্যান্ডসের আকর্ষণ থেকে দূরে থাকা গেল না। সহকর্মী পাঁচজন মিলে ঠিক করলাম দ্বিতীয় দিন গন্তব্য হবে এই শীতল জায়গাটি দর্শন করার।
রোববার (২০ জানুয়ারি) সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন ছিল কুয়ালালামপুরের আকাশ। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো সকাল ১১টায়, বাংলাদেশ সময় তখন সকাল ৯টা।
গেনটিং হাইল্যান্ডস বাসে করেও যাওয়া যায়। আমরা ঠিক করলাম টেক্সিতে যাওয়ার, অনলাইনভিত্তিক পরিবহন সেবা ‘গ্রাব’র কার ডাকা হলো অ্যাপস দিয়ে। ভাড়া উঠলো ১০১ রিঙ্গিত। দুপুর ১২টায় একটি কারে উঠলাম পাঁচজন। চালক মালয়েশিয়ান, তার নাম আদিল। কুয়ালালামপুর শহর ছেড়ে আঁকা-বাকা পাহাড়ি পথ দিয়ে এগিয়ে চললো কারটি। যাওয়া পথে চালক আদিল জানিয়ে দিচ্ছিলেন কোথায় কী দর্শনীয় স্থান।
স্টিয়ারিংয়ের ঠিক উপরে গুগল ম্যাপ চালু রেখে চালকের মোবাইল, বাকগুলো আসার আগেই ভয়েসের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে গুগল।
পাহাড়ি পথ বেয়ে ঘন জঙ্গল হয়ে ক্রমেই কার উপরে উঠছে। পাশের জানালার কাঁচ ভেদ করে চোখের দৃষ্টি পড়ছে কয়েক শ ফুট নিচে। ভয়টাও কাজ করছিল আমাদের। তবে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কারণ সড়ক ডিভাইডার এবং পাশে শক্ত করে তৈরি করা আছে ছোট দেয়াল। পাহাড়ি পথ হলেও সড়কের পাশে লাগানো হয়েছে সারি সারি গাছ। আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূর পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের ভেলা।
ঘুরে ঘুরে কার উঠছে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়া বরাবর। সামনে পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় দেখা যাচ্ছে বহুতল ভবন। এরই মধ্যে হঠাৎ আকাশ কালো করে খানিক বৃষ্টি হলো। তখন কিছুটা পরিষ্কার আকাশ। কারটি গিয়ে থামলো বহুতল ভবনের সামনে। চালক আদিল জানিয়ে দিলেন কোথায় টিকিট কাটতে হবে। ততক্ষণে আবারও আকাশ কালো করে এলো। শরীর প্রায় হিম হয়ে গেল।
স্কাই ভিউ এভিনিউ ভবনে ঢুকে তিনটি চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ক্যাবল কারের কাউন্টারের সামনে। সারিবদ্ধভাবে সেখানে টিকিট কাটছেন দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীরা। আমরাও যাওয়া-আসা মিলে ১৬ রিঙ্গিত দিয়ে প্রতিজন টিকিট কাটলাম।
সিকিউরিটি চেকিং শেষে টিকিট পান্স করে পৌঁছে গেলাম ক্যাবল কারের কাছে। স্কাইওয়ে স্টেশনে যেখানে ক্যাবল কারে উঠতে হয় নাম তার 'অ্যাওয়ানা স্টেশন'। শক্ত মোটা স্টিলের তারে বাধা কারগুলো আসছে, উঠছেন দর্শনার্থীরা। আমরা পাঁচজন মিলে উঠলাম একটিতে। ছবির জন্য ক্লিক করছেন সবাই। একটু দূরে গিয়ে দরজা অটোমেটিক বন্ধ হলো। তার এগুতে থাকলো, মজবুত খুঁটির মাথায় বিশেষ কায়দায় তারে বাধা কারও উঠতে থাকলো উপর দিকে। খানিক দূর পর পর একটি করে খুটি। খুটির কাছে গেলে কিছুটা ঝাকুনি দেয় কার, সে সময় একটু আতঙ্ক আর ভয়ও কাজ করে। তবে গেনটিং জয়ের প্রত্যাশায় সেই ভয় কেটে যেতে সময় নেয় না বেশিক্ষণ। এভাবে ১৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে স্কাই এভিনিউ স্টেশনে নেমে পড়লাম আমরা।
বেলা একটা নাগাদ সূর্য তখন মেঘে ঢাকা। তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। জায়গাটি ধোঁয়াশার মতো, তবে সেটি হয়েছে ভেসে যাওয়া মেঘের কারণে। গায়ে এসে লাগছে মেঘ। যেন হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাচ্ছে। মেঘের ভেলা শরীর স্পর্শ করছে।
স্কাই এভিনিউয়ে রয়েছে আবাসিক হোটেল ফার্টওয়ার্ল্ড, ফুড কোট, কেনাকাটার জন্য বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর আউটলেট। পাহাড়ের চূড়ায় এসে কেউ খালি হাতে ফিরছেনও না। দাম একটু বেশি হলেও সেরা জিনিসটাই পাওয়া যায় এখানে। পায়ের জুতা থেকে শুরু করে সব ধরনের কাপড়, অলংকার এবং প্রয়োজনীয় শখের সব জিনিস।
কিছু কেনাকাটা করে এবার ফেরার পালা। একটি কারে উঠে পড়লাম আমরা, সঙ্গে দুই বিদেশি।
মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি মন্দির। চিন সুই টেম্পল স্টেশনে নেমে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সেই মন্দিরটিও দেখলাম আমরা। প্রায় ২০ তলা উঁচু মন্দিরটি কারুকাজে অনন্য। সেখানে রয়েছে আরও কয়েকটি ভাষ্কর্য। পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে গুহা। দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে সাজানো হয়েছে মনোরম করে। হাজারো পর্যটক সেখানে ছবি তুলছেন।
দেরি না করে আমরা এই স্টেশন থেকে উঠে পড়লাম ফিরতি আরেকটি কারে। উপর থেকে নিচে চোখ গেলে গা শির শির করে উঠবে যে কারোরই। উপর থেকে দেখা গেল বেশ কয়েকটি ভবন, একটি ভবনের চূড়ায় হেলিপ্যাড।
ক্যাবলকারের প্রথম স্টেশনে নেমে পড়লাম আমরা। এখানেও কেনাকাটার জন্য রয়েছে বড় বড় আউটলেটস। এক কর্মী জানালেন কারের সংখ্যা ১০০টি।
এক সময় এই পাহাড়ে মানুষের বসতি ছিল দীর্ঘদিন। পরে স্থানটিকে পর্যটকের জন্য হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ক্যাবলকার স্থাপন করা হয়েছে।
পাহাং ও সেলাংগর অঙ্গরাজ্যের সীমানায় প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচুতে তিতিওয়াসাং পাহাড়ের উপর গেনটিং হাইল্যান্ডস চালু হয়েছ ১৯৬৫ সালে। এতোদিনে চিনে গেছে গোটা বিশ্ব।
৩.৩৮ কিলোমিটার ক্যাবলকারে ঘুরতে প্রতিদিনই ঢল নামছে হাজোরো দর্শনার্থীর। এই দর্শনার্থী টেনে শক্তিশালী হচ্ছে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৮
এমআইএইচ/এএটি