স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার অভিযোগ, ‘আপা তো (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) নৌকা ভাড়া দেয়। আমাদের তো মূল্যায়ন নাই।
অন্য এক নেতা বলেন, ২০০৮ সালে আমাদের জেতার সমুহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মান্না ভাই সংস্কারপন্থি হওয়ায় তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হলেন। তারপরও আমাদের জেতার সম্ভাবনা ছিল, অচেনা আকরাম হোসেনকে প্রার্থী করা এবং পরে প্রত্যাহার করে জাতীয় পার্টিকে আসন ছেড়ে দেওয়ায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
তৃণমূলের নেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাইফুল হক হীরার মতে, বারবার আসন ছেড়ে দেওয়ায় ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে আওয়ামী লীগ। কোন নেতা ভোটারের কাছে জনসংযোগে গেলে যে কেউ মুখের ওপর বলে দেয়, আপনাদের দল করে লাভ কি, প্রার্থী তো দেবে জাতীয় পার্টি। এখানে আওয়ামী লীগের পরিচয়ই হয়ে গেছে ‘নৌকা ভাড়া দেওয়া দল হিসেবে। ’
তবে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, দলে তো হতাশা আছেই। কিন্তু দলীয় হাইকমান্ডের কথা তো আমাদের শুনতে হবে। তবে একটা কথা বলতে চাই, আমরা নৌকা ভাড়া দেই না। নৌকা ছেড়ে দেই।
বগুড়া শহর থেকে মহাসড়ক ধরে ৯ কিলোমিটার উত্তরে এগুলেই পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক স্থান প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী মহাস্থানগড়। ডানে মোড় নিয়ে সরু পথে এগুলে হাতের বাঁয়ে থাকে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় পাইকারি সব্জির মোকাম ‘মহাস্থান’। এ পথ দিয়ে আরো ১১ কিলোমিটার এগুলেই গাংনাই নদী পাড়ের ছোট মফস্বল শহর শিবগঞ্জ। শান্ত এই জনপদের কোথাও রাজনৈতিক কোন উত্তাপ নেই।
বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই উপজেলা নিয়েই জাতীয় সংসদের বগুড়া-২ আসন গঠিত। দুই লাখ ৯১ হাজারেরও বেশি ভোটারের এ আসনে জামায়াতে ইসলামীরও রয়েছে শক্ত অবস্থান। ১৯৯১ সালের এরশাদ পরবর্তী নির্বাচনে এ আসনটিতে বিএনপিকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী শাহাদাত-উজ-জামান।
এছাড়া ৫ জানুয়ারি নির্বাচন, সাঈদীর ফাঁসি কেন্দ্রিক সহিংসতা বা ২০১৪ সালের সহিংসতায় বিএনপির চেয়ে জামায়াতকেই বেশি দেখা গেছে মাঠে। মোকামতলা ও মহাস্থান পয়েন্টকে তারা তাণ্ডবক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। গত উপজেলা নির্বাচনেও জামায়াত প্রার্থী মওলানা আলমগীর হুসাইন ৭৪ হাজার ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন শিবগঞ্জের। বিএনপির প্রার্থী মতিয়ার রহমান মতিন এ নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলেন ৬৮ হাজার, আর আওয়ামী লীগের আজিজুল হক পেয়েছিলেন মাত্র ২৫ হাজার ভোট।
১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী রেজাউল বারী দিনা ও এ কে এম হাফিজুর রহমান। ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর এ আসনটি কখনোই বাগে আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ। তবে স্থানীয় নেতাদের দাবি, বর্তমানে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনে গতি নেই কেবল কেন্দ্রের অবহেলা আর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে।
১৯৯১ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পান দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না।
নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতিটি নির্বাচনেই ভোট বেড়েছে আওয়ামী লীগের। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, বর্তমানে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভোটের ব্যবধান ৩০ হাজারেরও কম। কিন্তু ২০০৮ ও ২০১৪ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আকরাম হোসেনকে বাদ দিয়ে ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গী জাতীয় পার্টির প্রার্থী শরীফুল ইসলাম জিন্নাহকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ভর করে।
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দাবি, ২০০৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে এলাকায় ভালো অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন দলের সে সময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না। কিন্তু সংস্কারপন্থি হওয়ায় দলের হাই কমান্ড তাকে মনোনয়ন না দিয়ে প্রার্থী করেছিলো আকরাম হোসেন খানকে। তবে শেষ সময় এসে নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী জিন্নাহকে আসন ছাড়ে আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী হাফিজুর রহমান এক লাখ ৩৪ হাজার ৫৫৯ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। জিন্নাহ ভোট পেয়েছিলেন ৮৮ হাজার ৯৭৭টি। অন্যদিকে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মান্না পেয়েছিলেন ৪৭ হাজার ৮১৯ ভোট। এ আসনের জয়ী প্রার্থী বিএনপির রেজাউল বারী দিনা পেয়েছিলেন এক লাখ ১৬ হাজার ৮০৬ ভোট।
এদিকে, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে এ আসন ছেড়ে দেওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে মনোনীত আকরাম হোসেন খান অভিমানে গা ঢাকা দেন। হতাশায় নিমজ্জিত হন নেতা-কর্মীরাও। এরপর আকরাম হোসেন এলাকায় আসা বন্ধ করে দেন। দলের কোন কর্মসূচিতেও তাকে আর দেখা যায়নি। এমনকি দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ ছিন্ন করেন। এ ঘটনা দলের নেতাদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে।
অন্যদিকে শিবগঞ্জ আওয়ামী লীগ সভাপতির বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘুদের শ্মশ্মান দখল, জমি দখল, তদরিববাজির অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় খবর ছাপা, স্থানীয় মহাজোটের এমপির জনবিচ্ছিন্নতা, পরিবারতান্ত্রিক তদবির বাণিজ্য এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের লুটপাটের ঘটনাও আওয়ামী লীগকে পেছনে ঠেলেছে।
এমন অবস্থায় আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে স্থানীয় পৌর মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিক, থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আজিজুল হক, সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, সাবেক প্রার্থী আকরাম হোসেন খান ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের নাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৭
আরএম/জেডএম
** নওগাঁ-২: জুলুমে চাপা পড়েছে উন্নয়ন
** নওগাঁ-৪: এক মার্ডারেই তছনছ বিএনপি
** নওগাঁ-৪: ইমাজ প্রামাণিকেই নড়বড়ে আওয়ামী লীগ
** নওগাঁ-৪: ইমাজের ইমেজ নষ্ট পাঁচ পাণ্ডবে
** নওগাঁ-২: আতাঁত-বিবাদে ঘাঁটিতেই তিন ভাগ বিএনপি
** জয়পুরহাট-১: কোন্দলে আসন হারানোর ভয় আ‘লীগে