ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

শেষ ইচ্ছা জানালেন ‘তুমি ডুব দিও না জলে কন্যা’র গীতিকার  

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
শেষ ইচ্ছা জানালেন ‘তুমি ডুব দিও না জলে কন্যা’র গীতিকার   গীতিকার ও সুরকার আলমগীর কবির

পাথরঘাটা (বরগুনা): গীতিকার ও সুরকার আলমগীর কবির, যিনি সুরকে সংজ্ঞায় বেধে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সুরের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্মের আশা ও হতাশার কথা বলেছিলেন। ১১ হাজারের বেশি গান লিখেছেন এই গীতিকার।

বাংলা চলচ্চিত্রে রয়েছে তার কালজয়ী বেশ কয়েকটি গান।  

তবে কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের প্রখ্যাত এই গীতিকারও হারিয়ে গেছেন। তার গান সবার মুখে মুখে থাকলেও তাকে মনে রাখেনি। শেষ বয়সে এসে প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাচ্ছেন না। জীবন সায়াহ্নে অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটছে এ গীতিকারের।

বরগুনায় পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নে নিজ গ্রামে এখন বসবাস করছেন গীতিকার ও সুরকার মো. আলমগীর কবির।  

সরেজমিনে দেখা গেছে, খুবই অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় কাতরাচ্ছেন। একবার স্ট্রোকক করেছেন। শোয়া থেকে পড়ে গিয়ে কোমড়ে আঘাত পেয়েছেন একবার। ডায়াবেটিসসহ নানা বার্ধক্যজনিত রোগে তার সারা শরীরের বাসা বেঁধেছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া উঠতেও পারছেন না। তার পরিবার ছাড়া অন্য কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী খোঁজখবর নিচ্ছেন না। এমনকি তাকে ভুলে গেছেন তারও গ্রামের লোকেরাই। তাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারেননি তারা। চলচ্চিত্রে এতো অবদান থাকা সত্ত্বেও খোঁজখবর রাখছেন না কেউ।  

কেমন আছেন জানতে চাইলে আলমগীর কবির হাতের ইশারা দিয়ে ছোট কন্ঠে বাংলানিউজ প্রতিনিধিকে বলেন ‘ভালো  আছি’।  

শেষ ইচ্ছা কি এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘রাজা তুমি কার’ অ্যালবামটি তুলে দিতে চাই প্রধানমন্ত্রীর হাতে। পাশাপাশি তার চলচ্চিত্রসহ গানগুলো সংরক্ষণের জন্য দাবি করেন সরকারপ্রধানের কাছে। এর বেশি আর কিছু বলার মতো অবস্থা তার নেই।

প্রখ্যাত গীতিকার আলমগীর কবিবের জন্ম ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বরে। নব্বই দশকে জীবিকার প্রয়োজনে ছায়াছবির গান রচনা শুরু করেন কিনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পীরাই তার লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেলে।  

যেভাবে গানের ভুবনে এলেন: 

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বিজয়োল্লাসে উত্তাল। ১৯৭২ সালে বরগুনার মঠবাড়িয়া কলেজের স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত কবির লিখলেন ‘বাংলা আমার বাংলা প্রিয় বাংলা, রক্ত সরোবর দুলছে আর ঊর্ধ্ব গগনে লাল একটা নতুন সূর্য জ্বলছে’ 

নিজের সূর ও কন্ঠে গানটি গেয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি এই গীতিকার ও সুরকার আলমগীর কবিরের। ঢাকাই সিনেমায় শত শত গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন কবির। অনেক গানই এদেশের সব শ্রেণির মানুষের হৃদয়ের স্থান করে নিয়েছেন।

চলচ্চিত্রে তার অবদান

বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে রয়েছে আলমগীর কবিরের অনেক অবদান। অসংখ্য কালজয়ী চলচ্চিত্রের গানের স্রষ্টা তিনি। সিনেমায় তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, ‘চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি,  ‘খোদা তোমার এ দুনিয়ায় আমি এক এতিম অসহায়’, ‘আমার এ গান খানি যদি ভালো লাগে’, ‘বন্ধু তোমারে ডাকি ঘরে আর থাইকো না’, ‘তুমি ডুব দিওনা জলে কন্যা’, ‘মাটির কোলে খাঁটি মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়’, ‘আজব এই শহরে ওভাই মানুষ চেনা যায় না’ -  এমন অসংখ্য জননন্দিত গানের স্রষ্টা তিনি। যা শুনলে এখনও শ্রোতারা হারানো দিনের স্মৃতিতে কাতর হয়ে পড়েন।

যেসব চলচ্চিত্রে তিনি গান লিখেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য - ঝিনুক মালা, মাটির কোলে, মিয়া ভাই, শিমুল পারুল, ভাই আমার ভাই, নাগ মহল, শশী পূর্ণ, কোহিনূর ইত্যাদি।  

এছাড়া ‘রাজা তুমি ঘুমিয়ে আছো’  বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলমগীর কবিরের অনবদ্য সৃষ্টি। কালজয়ী গানে শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও রয়েছে অনেক জনপ্রিয়তা এবং সুনাম।

এসব জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ড্র কিশোর, সাবিনা ইয়াসমিন, রথীন্দ্রনাথ রায়, দিলরুবা খান, সুবীর নন্দী, খুরশিদ আলম, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী প্রমূখ।

গান লিখেছেন ১১ হাজারের বেশি:

বার্ধক্যে এসেও অনেক গান লিখেছেন আলমগীর কবির। ২০০৭ সাল পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি গান লিখেছেন তিনি। এরপর আর হাতে কলম তুলে নেননি তিনি। জীবনের সায়াহে এসে ‘হৃদয় খুলে রেখনা’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ১০৭ টি গান। এছাড়াও তিনি ১১ হাজার ২৯৭টি গান, ১১টি ডায়েরীতে লিখে রেখেছেন। প্রতি ডায়েরিতে ১ হাজার ২৭ টি গান রয়েছে।

গীতিকারের ছোট ভাই দুলু বলেন, আমার ভাই বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় গীতিকার। তিনি সেই মূল্যায়ন পাননি এখনও। আমি চাই তিনি যেন তার সঠিক মূল্যায়ন পান। এছাড়াও তার একটি ইচ্ছে ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘রাজা তুমি কার’ এই ক্যাসেটটি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় ক্যাসেটটি এখনও দিতে পারেননি।

পাথরঘাটার প্রবীণ সাংবাদিক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বলেন, আমরা ছোট থেকেই তার গানের ভক্ত ছিলাম। এমন একটা সময় ছিল তার জনপ্রিয় গানগুলো সকলের মুখে মুখে ছিল। আজ সেই আলমগীর কবির অবহেলিত। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে এতো অবদান থাকা সত্ত্বেও  গ্রামে ধুকে ধুকে দিন পাড় করছেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.দেবাশীষ বেপারী বলেন, ‘অসাধারণ কথামালায় সাজানো দেশের গান, আধুনিক গানগুলো তার। অনেক কিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। আধুনিক গান গাওয়ার পদ্ধতি, কণ্ঠ সুর অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে। তার ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। এমন গুণী মানুষ আমাদের উপমহাদেশের গৌরব। তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার দাবি জানাচ্ছি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।