ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ডিস ব্যবসার আড়ালে চলত কালা জরিপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৩
ডিস ব্যবসার আড়ালে চলত কালা জরিপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

ঢাকা: ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় গত ১৫ বছর ধরে ডিস ব্যবসা পরিচালা করে আসছিলেন মো. জরিপ মিয়া ওরফে কালা জরিপ (৪০)। পাশাপাশি গড়ে তোলেন একটি সন্ত্রাসী বাহিনী, ১৫ বছর আগে জমির দালালি করতেন কেরানীগঞ্জ এলাকায়।

ডিস ব্যবসার আড়ালে তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে ব্যবহার করে অবৈধ ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, মাদকের কারবারসহ বিভিন্নি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। দখলদারিত্বের মাধ্যমে হাসনাবাদ এলাকায় জমি দখল করে সেখানে নির্মাণ করে হাসনাবাদ সুপার মার্কেট। আর সেই সুপার মার্কেটের একটি কক্ষকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন কালা জরিপ।

শুধু তাই নয়, ওই টর্চার সেলে নিয়মিত চলতো মদের আসর ও ফুর্তিবাজি। বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের সেখানে নিয়ে আসতেন কালা জরিপ ও তার সহযোগীরা। প্রায় সময়ই ওই টর্চার সেলে নারীদের এনে নির্যাতন ও ধর্ষণ করতেন সন্ত্রাসী কালা জরিপ।

হাসনাবাদ এলাকায় ত্রাস ছিলেন কালা জরিপ, তার ভয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষ অনেকটাই কোনঠাসা ছিলেন।  

চাঁদাবাজি, ভুমি দখল, মাদক, মারামারি, ধর্ষণ ও হত্যাসহ নানাবিধ অপরাধে কালা জরিপের নামে ২২টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে ১০টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। এরপরও দমেননি এই সন্ত্রাসী।

নিজের নামে থাকা মামলার স্বাক্ষীদের বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে কোর্টে যেতে দিতেন না। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ধরে টর্চার সেলে নিয়ে করা হতো নির্যাতন।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) ভোরে ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ এলাকার হাসনাবাদ সুপার মার্কেটে অভিযান চালিয়ে কুখ্যাত এই সন্ত্রাসী ও মাদক সম্রাট ও তার তিন সহযোগী মো. আনিসুর রহমান (৩৮), মো. জাহিদ ওরফে বাবু (৪৫) ও ঝুমুর আক্তারকে (২৬) অস্ত্র, মাদকসহ গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০।

অভিযানে তাদের কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগজিন, ১ রাউন্ড গুলি, ১টি টেজার গান, ১টি এয়ার পিস্তল, ১টি রাম দা, ১টি ছোরা, ১টি চাকু, ১টি লোহার এসএস পাইপ, ১টি কাঠের লাঠি, ৫৮০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৪ বোতল বিদেশী মদ, ১টি গাড়ি, ৭টি মোবাইল ফোন ও নগদ ১ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ টাকা জব্দ করা হয়।

বুধবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক (সিও) মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতার কালা জরিপ কেরাণীগঞ্জ এলাকার মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর হোতা। তার নেতৃত্বে কেরাণীগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা, অবৈধ ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন প্রকার সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তাদের কাজে কেউ বাধা দিলে জরিপ ও তার সহযোগীরা তাদের ধরে হাসনাবাদ সুপার মার্কেটে টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন চালাতো। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার হুমকিও দিতেন।

তিনি বলেন, জরিপের সহযোগী আনিছুর রহমানের দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের হাসনাবাদ হাউজিং এলাকায় একটি এসএস ওয়ার্কশপ রয়েছে। সে তার ব্যবসার আড়ালে কালা জরিপের সঙ্গে মাদক ব্যবসাসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। এছাড়া আনিছুরের নামে বিভিন্ন থানায় মাদক ও হত্যা মামলাসহ ২টি মামলা আছে বলে জানা গেছে।
    
তার অন্যতম সহযোগী মো. জাবিদ ওরফে রহিম দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানাধীন এলাকায় গার্মেন্টস ব্যবসা করে৷ এই ব্যবসার আড়ালে জরিপের সঙ্গে হাসনাবাদ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্যতম সহযোগী বলে জানা যায়।

র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক বলেন, হাসনাবাদ সুপার মার্কেটে তার টর্চার সেলে প্রায় সময়ই নারীদের নিয়ে ফূর্তি করতেন কালা জরিপ ও তার সহযোগী জাবিদ। সেখানে অভিযানের সময় কালা জরিপের নারী সহযোগী ঝুমুর আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। ঝুমুর প্রায় নিয়মিত তাদের সঙ্গে ফূর্তি করতে ওই টর্চার সেলে আসতেন।

এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, হাসনাবাদ সুপার মার্কেটে অবস্থিত কালা জরিপের এই টর্চার সেলে মাদকদ্রব্য ও নারীদের সরবরাহ করতেন তার সহযোগী আনিসুর রহমান। আর মিরপুর থেকে নিয়মিত জাবিদ এসে জরিপের আসরে যোগ দিতেন। সেখানে রাতভর মদ্যপান ও অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকতেন তারা।  

অভিযানকালে জাবিদের পাজেরো জিপ তল্লাশি করে তার লাইসেন্স করা একটি পিস্তল পাওয়া যায়। এছাড়াও পিস্তল সাদৃশ্য একটি অবৈধ এয়ার গানও পাওয়া যায়। যার কোনো লাইসেন্স নেই।  গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে, অস্ত্র আইনে ও মানবপাচার আইনে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন আছে।

জোরপূর্বক যৌনকাজে বাধ্য করছে এমন কোনো ভুক্তভোগীকে পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে এই  র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশের আইনে অবৈধ। সেটা জোর করে আনুক, আর স্বেচ্ছায় বা অর্থের বিনিয়ম আনুক, সেটা অবৈধ। কোনো ব্যক্তি যদি বিবাহ বর্হিঃভূত কোনো নারীর সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা করে তাহলে সেটি আইনের চোখে অপরাধ বটে।

জরিপের পেছনে ইন্ধন দাতা কে বা কারা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, জরিপ নিজেই একজন বড় সন্ত্রাসী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। হাসনাবাদ সুপার মার্কেটটি তার কথিত সম্পত্তি। এটাও তিনি দখল করে রেখেছেন। তার একটি সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। ওই বাহিনীতে ২২ জন সদস্য যুক্ত থাকার তথ্য ও নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। যাদের দিয়ে জরিপ সব ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তথ্য অনুযায়ী জরিপের নামে এখন পর্যন্ত ২২টি মামলা আছে, এর মধ্যে ১০টি বিচারাধীন।

তার নামে দায়ের করা মামলায় যারা সাক্ষী হিসেবে ছিলেন, প্রতিনিয়ত তাদের ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হতো। মূলত সে এলাকায় ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে।  তার টর্চার সেলে আগে বিভিন্ন সময় একাধিক নারীকে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। ইতোপূর্বে সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মামলায় জামিন নিয়েছে। কিন্তু তার অপরাধ তৎপরতা কেউ থামাতে পারেনি।

তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে অপরাধী এটাই তার পরিচয়। তবে তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আমরা পাইনি।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৩
এসজেএ/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।