রংপুর: সার, বীজ ও কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণের বাড়তি দামের কারণে গত মৌসুমের তুলনায় এবার বোরো উৎপাদনে কৃষকদের গুনতে হবে বাড়তি খরচ। প্রতি বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনে বাড়তি খরচ হবে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
সেই হিসাব অনুযায়ী রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে প্রায় ১৭২ কোটি টাকা। ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় শুধু সেচেই খরচ বাড়বে ১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে হাঁড় কাপানো শীতে চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রংপুর অঞ্চলের চাষিরা।
পীরগাছা উপজেলার কান্দি কাবিলাপাড়ার কৃষক আজিজুল হক বলেন, যেভাবে সউগ (সব) কিছুর দাম বাড়ছে হামার (আমার) মরা ছাড়া বাচন নাই। সার, বীজ ও পানি খরচ বাড়ছে। ডিজেলের দাম, বিদ্যুতের দামও বাড়ি গেইছে। সউগেরে দাম বাড়লেও মৌসুমের সময় ধানের দাম আর বাড়ে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুম থেকে। আর এর প্রায় অর্ধেকের বেশি জোগান দেয় উত্তরাঞ্চল। এ বছর বোরো মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে ৫ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে।
কৃষকরা জানান, গত বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে সেচের খরচ ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। বীজ প্রতি কেজি ছিল ২০০ টাকা, এবার তা হয়েছে ৩৫০ টাকা। এছাড়া জমি তৈরি ৯০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৩০০ টাকা, সার খরচ ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা, কীটনাশক ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা, ধান রোপণ ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, ধান কাটা-মাড়াই ৩ হাজার থেকে বেড়ে ৪ হাজার টাকা হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হবে জমির ভাড়া ৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়ছে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা।
কাউনিয়া উপজেলার টেপা মধুপুর এলাকার কৃষক আউয়াল মিয়া বলেন, এ সময় কৃষকের চোখে ঘুম নাই। প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে চারদিকে বোরোর জমি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকরা। কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। সরকারের উচিত ছিল কৃষি এবং কৃষকের কথা চিন্তা করে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা। এখন ডিজেল-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষকের ওপর দিয়েই ধকল যাচ্ছে। এমন করি যদি প্রতি বছর উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকলে কৃষক বাঁচবে কেমন করি!
একই এলাকার কৃষক আবুল করিম জানান, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবার সেচ খরচে বাড়তি টাকা যোগান দিতে হবে। আর এতেই বাড়বে উৎপাদন ব্যয়। সব কিছুর দাম বাড়ায় কোনোটাই আর আগের দামে পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া বোরো মৌসুমে রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং অব্যাহত থাকায় বাড়ছে অভিযোগ। ঠিক মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় চাষাবাদসহ উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিড়ম্বনায়।
পীরগাছা উপজেলার কৃষক তাজরুল ইসলাম বলেন, এখনও পুরোপুরি চাষাবাদ শুরু হয়নি তাতেই লোডশেডিং হচ্ছে। মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে কি অবস্থা হতে পারে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সূত্রে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর সেচ পাম্প ৬২ হাজার ৭৫৩টি, অগভীর ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৪টি, ডিজেলচালিত গভীর ৩৩২টি এবং অগভীর সেচ পাম্প রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজার ১৮টি। বোরো ধান সেচনির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় সেচে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর-অগভীর সেচ পাম্পের সংখ্যা ৩ লাখ ১২ হাজার ৫২৭টি এবং ডিজেলচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩০টি। শুধু সেচেই কৃষকের ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
জাতীয় কৃষক সমিতি রংপুরে সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি জানান, কৃষকরা চরম বিপকে পড়েছেন। কৃষিতে খরচ বাড়লেও প্রান্তিক, বর্গা আর গরীব কৃষকদের হাতে কিন্তু টাকা-পয়সা নাই। অথচ তারাই প্রধান কৃষক। সরকারের উচিত সরাসরি মাঠে গিয়ে তাদের একটি তালিকা করে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। তারা যেন প্রণোদনা পান, তা নিশ্চিত করা। এটা সম্ভব হলে উৎপাদনের ধারাটা সচল রাখা সম্ভব হবে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, কৃষদের সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তারা যেন খরচ কমাতে পরিমিত সেচ এবং নিয়ম মেনে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বোরো চাষে অতিরিক্ত সেচ দিতে হয়। সেচ দিতে যেন পানির অপচয় না হয় সে জন্য কৃষকদের লক্ষ্য রাখতে বলা হচ্ছে। আমাদের সুষম সারের ব্যবহারে উৎপাদন যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্য কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৩
এফআর