বগুড়া: ঋতুচক্রে এখন শীতকাল। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় বছরের এ সময়ে যমুনার চরাঞ্চলের মানুষের বাহন হিসেবে নৌকার সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাটারিচালিশ ইজিবাইক ও ঘোড়ার গাড়ি।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার অনেক ইউনিয়ন যমুনা নদীবেষ্টিত হওয়ায় এসব ইউনিয়নের মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকায়, ইজিবাইক ও ঘোড়ার গাড়ি করে নানা ধরনের পণ্য কিনে আনা-নেওয়া করেন।
৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সারিয়াকান্দি উপজেলার কালিতলা বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বালুচরে চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের ভরসা ইজিবাইক ও ঘোড়ার গাড়ি।
প্রাকৃতিকভাবেই চরাঞ্চলে মানুষগুলো ভীষণ অসহায়। প্রাকৃতিক সৃষ্টির বিশাল জলরাশি যমুনায় মাঝে তাদের বেঁচে থাকা। ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথটাও তুলনামূলকভাবে অসীম নয়। যমুনায় প্রকৃতির সৃষ্টি বিশাল জলরাশি ও বালুচরে এ মানুষগুলোর জীবন সংগ্রাম। ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথটাও সীমিত। তাই বলে বেঁচে থাকার লড়াইটা বন্ধ রাখলে তো আর চলবে না। বাঁচার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তাই ইজিবাইক ও ঘোড়ার গাড়িতেই চলছে সেই লড়াই।
জানা যায়, নদীবেষ্টিত এলাকার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে নানা ধরনের নিত্য ব্যবহার্য মালামাল বহনে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি এ কাজে যুক্ত হয়েছে থ্রি-হুইলারের ইজিবাইক ও অটোরিকশা। এখন চরাঞ্চলের অনেক মানুষ ঘোড়ার গাড়ি ও ইজিবাইক দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, চরাঞ্চলের এ মানুষগুলো বছরের বার মাসকে বিভক্ত করে চলতে শিখেছে। কখনো নৌকায় ভেসে, পায়ে হেটে আবার কখনো প্রয়োজনের তাগিদে ইজিবাইক ও ঘোড়ার গাড়িতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করছেন চরাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ।
ব্যবসা ও বসতবাড়িসহ নানা ধরনের কাজে নৌকায় করে পণ্য আনা-নেওয়ার কাজও করেন তারা। খেয়াঘাটে যেতে বা নৌকা থেকে নেমে পণ্য পরিবহন ও চরের ভেতরে যাতায়াতে ইজবাইক ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করেন চরের বাসিন্দারা। চরে উৎপাদিত ছন, পাট, বাদাম, মরিচ, ধান, পাট, কাউন, ভুট্টাসহ মৌসুমি বিভিন্ন ধরনের মালামাল সাধারণত ঘোড়ার গাড়িতে বহন করে এসব চরাঞ্চলের মানুষগুলো।
সারিয়াকান্দির কালিতলা বাঁধ এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহিম আলী, জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলানিউজকে জানান, শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় যমুনা নদীতে চর পড়েছে। এ কারণে খেয়াঘাট করতে হয়েছে মূল ঘাট (কালিতলা বাঁধ) থেকে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে মাদারগঞ্জ, জামথইল, জামালপুরসহ বিভিন্ন রুটে নৌযান চলাচল করছে। তাই চরাঞ্চলের মানুষরা মূল ঘাট থেকে নতুন গড়ে ওঠা খেয়াঘাটে ইজিবাইকে যাত্রা করছেন। সেক্ষেত্রে তাদের ভাড়ায় অতিরিক্তি ২৫-৩০ টাকা গুণতে হচ্ছে।
তারা বলেন, চরাঞ্চলের ফসল পরিবহনের দিক দিয়ে আবার চিত্রটা ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে ঘোড়ার গাড়ির বিকল্প নেই। চরাঞ্চলের ঘোড়ার গাড়িগুলোতে ১২-১৬ মণ ওজন বহন করা হয়ে থাকে। যা ইজিবাইকে বহন করা সম্ভব না। গড়ে এসব গাড়ি দিনে প্রায় ৫০ কিলোমিটারের বেশি চরের বালুময় রাস্তায় চলাচল করতে পারে।
জামালপুরের পথে যাত্রা করেন তোজাম শেখ। তিনি বাংলানিউজকে জানান, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন সারিয়াকান্দি উপজেলরা সদর এলাকায়। তিনি ও তার ছোট ছেলে তিন দিন মেয়ের বাড়িতে জামাই, নাতি-নাতনিদের সাথে কাটানোর পর নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। যাতায়াতে নৌপথই তাদের ভরসা।
কেননা স্থলপথে যেতে সময় ও টাকা দুটোই বেশি লাগে। প্রথমে তাদের কালিতলা বাঁধ এলাকায় আসতে হয়েছে। অল্প এ পথ পায়ে হেঁটেই এসেছেন। নদীতে পানি না থাকায় ও খেয়াঘাট দূরে চলে যাওয়ায় নৌকা ধরতে এখন তাদের ইজিবাইকে করে চরের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে এ ভাবেই চলতে হয় তাদের বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইজিবাইকচালক হামিদ মিয়া, খালেদ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে খেয়াঘাট কালিতলা বাঁধ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চলে যায়। এ পথ অতিক্রম করতে আগে মানুষ ঘোড়ার গাড়ি ও পায়ে হেঁটে যাত্রা করতেন। কিন্তু সম্প্রতি এখানে ইজিবাইক ও সিএসজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু করেছে। এতে যাত্রীদের অতিরিক্ত টাকা গুণতে হলেও রোদে কষ্ট করতে হয় না। মৌসুমের এ সময়ে তাদের মতো অনেকেরই জীবিকা এখান থেকে বেশ ভালোভাবেই চলছে বলেও জানান তারা।
এদিকে ঘোড়াগাড়ি চালক কুদ্দুস, পিন্টুসহ কয়েকজন চালক বাংলানিউজকে জানান, অনেক বছর ধরে তারা ঘোড়ার গাড়িতে চরাঞ্চলে উৎপাদিত ফসল পরিবহনের কাজ করে আসছেন। চরে উৎপাদিত ছন, বাদাম, মরিচসহ মৌসুমি বিভিন্ন ধরনের মালামাল সাধারণত ঘোড়ার গাড়িতে বহন করেন এসব চরাঞ্চলের মানুষগুলো। পণ্য বহনে তারা কিলোমিটার প্রতি ২০-৩০ টাকা হারে ভাড়া পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭শ টাকা আয় হয় তাদের।
সবমিলিয়ে বলা চলে চরাঞ্চলে মানুষগুলো প্রাকৃতিক সৃষ্টির বিশাল জলরাশি যমুনায় মাঝেই কোনো না কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহের পথটা ঠিকই বের করেন। যমুনায় প্রকৃতির সৃষ্টি বিশাল জলরাশি ও বালুচরে এ মানুষগুলোর জীবন সংগ্রাম এমনই।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
এএটি