খুলনা: খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম কামরুজ্জামান দায়িত্ব পালনকালে সোর্স নামধারী একাধিক ‘দালালচক্র’ গড়ে তুলেছিলেন।
এদের মাধ্যমে তিনি ঘুষ বাণিজ্য করতেন।
এছাড়া বাগেরহাটের রামপালে গ্রামের বাড়িতে শত শত বিঘা জমি কিনে করেছেন মাছের ঘের।
খুলনা থানা সূত্র ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, রাজশাহী রেঞ্জ থেকে এসএম কামরুজ্জামান খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় যোগদান করেন। এরপর তাকে নগরীর খালিশপুর থানায় ও পরে সদর থানায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চে ওসি হিসেবে পাঠানো হয়।
যোগদানের কিছুদিন পরেই খুলনা স্টেডিয়াম মার্কেটে জুতা তৈরি তিন কারিগরকে থানায় ডেকে জুতা তৈরি করে দেওয়ার জন্য বলেন। তখন কারিগররা কারখানায় গিয়ে জুতা তৈরির কথা বললে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের মারপিট করেন। এর প্রতিবাদে খুলনার সমস্ত জুতা কারিগর ও জুতা তৈরি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এসময় তাদের দমন করতে আরও ১৭ জনকে থানায় নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন ওসি কামরুজ্জামান।
২০১১ সালের ১২ এপ্রিল খুলনা মহানগরীর নিরালা এলাকায় এক টুকরো লোহা চুরির অপরাধে ১০ বছরের শিশু বেলালকে চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পড়িয়ে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে ওসির রুমে নির্যাতন চালানো হয়। এতে শিশুটি কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
এ ঘটনা জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ হলে পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন গত বছরের ৮ মে ওসি কামরুজ্জামানসহ দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না’ মর্মে রুল জারি করেন।
তারপরও দমে যাননি কামরুজ্জামান। ওই ঘটনার একমাস যেতে না যেতেই ১০ মে নগরীর হাজি মুহসিন রোডের একটি বাড়িতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকজন শিশু মারামারি করলে পুলিশ এইচএম ফারহান সাদিক বাবু (১২) ও শাকিল আহমেদকে (১৫) আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
পরে তাদের চোখ বেঁধে ওসি কামরুজ্জামানের রুমে বেধড়ক পেটানো হয়। তাদের মিথ্যা পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
কামরুজ্জামানের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ছিল বলে সূত্র জানায়।
সূত্র আরও জানায়, এসআই ইমরান, কনস্টেবল মাসুদ, আবু সুফিয়ান, মামুন ও গাড়ি চালক সুধাংশুকে দিয়ে ওসি কামরুজ্জামান তথাকথিত একটি সোর্সবাহিনী গড়ে তোলেন। সোর্সদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শাহজাহান ও আজিজ নামে আরও দুই ব্যক্তি।
এদের মাধ্যমে তিনি প্রতি রাতে সদর থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসতেন। রাতভর তাদের সঙ্গে চলতো দেন-দরবার। ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে এক একজনের কাছ থেকে তিনি ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করতেন। কেউ টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তিনি পরের দিন তাকে পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দিতেন।
এছাড়া নগরীর বিভিন্ন মাদক বেচাকেনার স্পট থেকেও প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন। এভাবে গড়ে তুলেছেন টাকার পাহাড়।
এই কালো টাকা দিয়ে ওসি কামরুজ্জামান নগরীর অভিজাত বাগমারা এলাকায় ১২ কাঠা জমির ওপর চারতলা বাড়ি ও পাশে ছয়তলা ফাউন্ডেশনের একটি টিনসেডের বাড়ি করেছেন। যার বর্তমান বাজার দর প্রায় ৫ কোটি টাকারও বেশি।
ঢাকার উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাড়ির মালিকও ওসি কামরুজ্জামান। এছাড়া রাজধানীর বনানীসহ অন্যান্য স্থানেও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
সূত্র জানায়, ওসি কামরুজ্জামান যাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসতেন টাকার জন্য তিনি তাদের ওপর শুধু নির্যাতনই করতেন না, তার অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলদের সঙ্গেও কারণে-অকারণে করতেন চরম দুর্ব্যবহার। কিন্তু তার মানসিক অত্যাচারে জর্জরিত হলেও তাদের কিছুই করার ছিল না।
অনেক সময় তিনি দম্ভ করে বলতেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আমার অনেক লোক রয়েছে। তাই আমি কাউকেই পরোয়া করি না।
সোমবার কয়েকজন পুলিশ সদস্য সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ভাই আমরা কিছু করতে না পারলেও আপনারা ঠিকই তার মুখোশ খুলে দিয়েছেন। এ শাস্তি তার আগেই হওয়া উচিত ছিল। ’
এসএম কামরুজ্জামান বাগোরহাট জেলার রামপাল উপজেলার উজুলপুর ইউনিয়নের তুলশিরাবাদ গ্রামের দরিদ্র কৃষক আব্দুল মান্নানের ছেলে। চার ভাইবোনের মধ্যে কামরুজ্জামান সবার বড়।
কামরুজ্জামান স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে ১৯৮৫ থেকে ৮৭ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি কলেজে পড়ালেখা করেন।
দরিদ্র পিতার সংসারে অভাব অনটনের কারণে কামরুজ্জামান রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের হাফিজুর রহমান মোল্লার বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে থেকে পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি ১৯৮৮ সালে পুলিশের এএসআই পদে চাকরি নেন। সারদায় ট্রেনিং শেষে তিনি কুষ্টিয়া, যশোর, ভোলা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ছিলেন।
কুষ্টিয়ায় কর্মরত অবস্থায় তিনি এক মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় আপত্তিকর অবস্থায় এলাকাবাসী তাকে ধরে ও মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।
কিছুদিন পর তিনি ভোলার বোরহানউদ্দিন থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন। এখানে তার অপকর্মে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে তার কপাল ফেটে যায়। সেই ক্ষত চিহ্ন এখনও বহন করছেন ওসি কামরুজ্জামান।
২০০৯ সালের ১৫ মার্চ সাতক্ষীরার সদর থানার ওসি হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মাথায় এপ্রিল মাসে কামরুজ্জামান আওয়ামী সমর্থিত লোকজন নিয়ে সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল দখল করেন। এভাবেই সাতক্ষীরার রাজনৈতিক অঙ্গন, পরিবহন সেক্টর, চোরাচালান জগত, সন্ত্রাসীদের আন্ডারওয়ার্ল্ড- সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন কামরুজ্জামান।
ওসি হিসেবে খুলনা থানার দায়িত্ব গ্রহণের পর কামরুজ্জামান বিরোধীদলের নেতাকর্মী দমনের বিশেষ স্কিম নেন। এমনকি ইতোপূর্বে হরতাল চলাকালে খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করেন।
এ ছবি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রপত্রিকায় আসার পর খুলনার মানুষ তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়।
ইতোপূর্বে খুলনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা না করলেও গাড়ি ভাংচুর ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার নজির সৃষ্টি করেন।
তার এসব অতিউৎসাহী কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারি দলের নেতারাও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। সরকার দলীয় কয়েকজন নেতা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন ওসি কামরুজ্জামান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, নিজেকে কখনও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবার খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন ওসি কামরুজ্জামান।
তবে খুলনার মেয়র বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘ওই ওসি তার কোনো আত্মীয় নন। ’
রোববারের ঘটনার পর কামরুজ্জামান তার শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকারিদলের একাধিক প্রভাবশালী নেতাদের বাসভবনে যান এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন বলে জানায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ একাধিক সূত্র।
সূত্র জানায়, ওসি নিজেকে সরকারি দলের লোক দাবি করে নেতাদের বলেন, ‘আপনাদের কথার বাইরে আমি কখনও যাইনি। আমাকে রক্ষা করার দায়িত্বও আপনাদের। ’
এদিকে, রোববারের ঘটনায় সাংবাদিদের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ওসি কামরুজ্জামান।
সোমবার সদর থানায় গিয়ে দেখা যায়, ওসির টেবিলের সামনের একটি চেয়ারে সদ্য ক্লোজ হওয়া ওসি কামরুজ্জামান পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে আছেন।
সাংবাদিকরা ওসির কক্ষে ঢুকতে চাইলে প্রথমে তাদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
পরে সাংবাদিকরা ওই কক্ষে ঢুকে প্রশ্ন করেন, তিনি সামনের চেয়ারে বসা কেন।
তখন উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা এমন কোনো বিষয় নয়। আপনারা এতো ছবি তোলাতুলি করছেন কেন? আমার এমন কি হয়েছে, শুধু ক্লোজ করা হয়েছে। এ আর এমন কি?’
এ সময় দু’ছাত্রকে ঝুলিয়ে নির্যাতনের কথা স্বীকার করে তিনি দ্রুত থানা থেকে বাসায় চলে যান।
এদিকে, থানার ভেতর চোখ বেঁধে ফ্যানে সঙ্গে ঝুলিয়ে ছাত্রদলকর্মী টিটো ও মুন্নাকে নিষ্ঠুর নির্যাতনের অভিযোগে ওসি এসএম কামরুজ্জামান ও তিন কনস্টেবলকে ক্লোজ করায় পুলিশসহ রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
তবে ক্লোজড হওয়া ওসি কামরুজ্জামানের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ সাতদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠনসহ খুলনার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ওসি কামরুজ্জামানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সফিকুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ইতোমধ্যে ঘটনা তদন্তের জন্য নগর বিশেষ শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার আলী হায়দার খানের সমন্বয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তদন্তের একদিন পেরিয়ে যাওয়ায় অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত চলছে। এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। ’
সোমবার দুপুরে টিটো, মুন্না ও মনিরুল ইসলামকে খুলনার মহানগর হাকিম স্বপন কুমার সরকারের আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জিলহাজ উদ্দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন জানালে আদালত শুনানি শেষে তাদের রিমান্ড না মঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুমতি দেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জিলহাজ বাংলানিউজকে জানান, সময়সাপেক্ষে তাদের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওই তিনজনসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও দেড় থেকে দু’শতাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে এসআই শাহ আলম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
উল্লেখ্য, রোববার হরতালের সময় গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদলকর্মী এসএম মাহমুদুল হক টিটো ও ফেরদাউসুর রহমান মুন্নাকে চোখ বেধে ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেন ওসি কামরুজ্জামান।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১২
প্রতিবেদন: মাহবুবুর রহমান
সম্পাদনা: তানিয়া আফরিন, নিউজরুম এডিটর/সাইফুল ইসলাম, কান্ট্রি এডিটর