জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, (জাবি): দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সারা বছরই নাটক, কবিতা পাঠের আসর, সঙ্গীতানুষ্ঠান, বিতর্ক, সেমিনারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
জানা গেছে, যেকোনো অনুষ্ঠানে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে চলে মাদকের অবাধ ব্যবহার। মাদকসেবীদের কারণে একদিকে নষ্ট হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিবেশ; আরেক দিকে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে আসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় অস্বস্তিকর অবস্থায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়া সাবেকরাও মুখিয়ে থাকেন প্রাণের ক্যাম্পাসে আসতে। কিন্তু মাদকের ছড়াছড়ি এতই, পরিবার-পরিজন নিয়ে এসে তারা হন অপমানিত; পড়েন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
এতে ক্ষতি দুদিক দিয়ে। এক. বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সম্মান; দুই. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারক ও শিক্ষকদের ভূমিকা নষ্ট হওয়া। মাদকের প্রতুলতার কারণে সাবেক-বর্তমান বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পরিবার আসা কমিয়ে দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মুক্তমঞ্চে অবাধে মাদকসেবনের ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া হিয়া বলেন, বহিরাগত বা ক্যাম্পাসের মানুষজন প্রচুর ধূমপান করে। সিগারেট-গাঁজার গন্ধ আর ধোঁয়ায় মেয়েদের প্রচণ্ড সমস্যা হয়। অনেকের শ্বাসকষ্টও হয়। সম্প্রতি আমার এক বান্ধবীর সিভিয়ার প্রব্লেম হয়েছিল। যাদের ব্রঙ্কাইটিস বা ব্রিদিং ইস্যু আছে, এমন অনেকেই এখন অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়ে কনসার্ট বা মুক্তমঞ্চে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেন না। যাদের আগের কোনো মেডিকেল ইস্যু নেই, তারাও ক্রমাগত ধোঁয়ায় অসুস্থ অনুভব করেন। বার বার অনুরোধ করলেও কেউ কথা শোনে না। আর এসব দেখেও নিয়ন্ত্রণ করে না কেউ।
আলিফ হাসান আরেক শিক্ষার্থী মুক্তমঞ্চের মাদকসেবন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন। তার ভাষ্য, সিগারেট আর গাঁজার ধোঁয়া ছাড়া কোনো কনসার্ট দেখেছি বলে মনে পড়ে না বিগত ৫ বছরে। একটা বদ্ধ জায়গায় চারদিক থেকে ধোঁয়া এলে, শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে যায়। তবে ইদানীং স্টেজ ও এর আশপাশে মাতলামি করার প্রচলনটা ভালই বেড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সামি আল জাহিদ প্রীতম বলেন, ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে মুক্তমঞ্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উন্মুক্তভাবে মাদক গ্রহণ ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণের যে ঘটনা ঘটছে তা উদ্বেগজনক। আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা মুক্তমঞ্চকে পবিত্রস্থান হিসেবেই গণ্য করি। আমাদের কাছে এসব ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রশাসনকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। কনসার্ট বা এ ধরনের জন্য বিকল্প কোনো স্থান নির্বাচন করাও এখন সময়ের দাবি। ক্যাম্পাসের প্রোগ্রামগুলোয় বহিরাগত নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে সচেতন হতে আহ্বান জানান তিনি।
ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আলমগীর কবির বলেন, কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে আমার এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তবে এরকম ঘটনাগুলো প্রোগ্রামকেন্দ্রিক হওয়ায় শক্ত অবস্থান নেওয়া কষ্টকর। বিষয়গুলো ব্যাপক আকার ধারণ করার আগে আমরা যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম তাহলে কিছুটা হলেও এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আগামী শৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের সাথে কথা বলবো।
দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। আমরা এখন একটা অভিভাবকহীন অবস্থায় রয়েছি। এ অভিভাবকত্বহীনতা আমাদের অবক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ছাত্র থাকা অবস্থায় এমন হলে ছাত্রত্ব চলে যেত। ধূমপান আর গাঁজাসেবন কোনোভাবেই এক হতে পারে না। মাত্রাতিরিক্ত কনসার্ট বা অনুষ্ঠান পড়াশোনার পরিবেশকে নষ্ট করছে। প্রশাসনের উচিত মাদকসেবন রোধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে ব্যবস্থা নেওয়া।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ. স. ম. ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, পদক্ষেপ তো নেওয়াই যায়। তবে ভিড়ের মধ্যে কে মাদকসেবন করছে তা খুঁজে বের করে সমাধান করা তো সম্ভব না। আর যারা প্রোগ্রামগুলোয় অংশ নেয় তারা তো বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। সে হিসেবে তাদেরও কো কিছু দায়িত্ব আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জননন্দিত মঞ্চে গিয়ে এ ধরণের ঘটন গুলো ঘটাচ্ছে, তাদের কতটুকু শ্রদ্ধা এ মঞ্চের প্রতি আছে? এক্ষেত্রে আমাদের বিভাগ বা শিক্ষকদের মাধ্যমে অ্যাডভোকেসি করা দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা এসব প্রোগ্রামগুলোকে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলে।
নিজেদের উপভোগ্যের জন্য পুরো কমিউনিটিকে যেন বিপদের মধ্যে না ফেলে; মুক্তমঞ্চের যে মর্যাদাটা রয়েছে তা রক্ষায় শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০২৩
এমজে