ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যেসব কারণে ঘটেছে সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণ!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০২৩
যেসব কারণে ঘটেছে সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণ!

ঢাকা: সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেটে বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ খুঁজছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে, প্রাথমিক কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন ভবনে জমে থাকা গ্যাসের জন্য ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে।

তা ছাড়া কারণ, হতে পারে আরও।

জানা গেছে, ১৯৯২ সালে নির্মিত ভবনটি ছিল একতলা। সেখানে কুইন ক্যাফে নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল। এর রান্নাঘর ছিল ভবনের বেজমেন্টে। রান্নাঘরে ছিল আবার কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন; যা পরবর্তীতে লিখিত আকারে তিতাসের কাছে সমর্পণ করা হয়।

২০০৪ সালে ভবনটি ৭ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়। ভবনের প্রকৃত মালিক হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান। ২০১১ সালে তার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ সূত্রে ভবনের বর্তমান মালিক তার স্ত্রী, ও পাঁচ ছেলে-মেয়ে (তিন ছেলে-দুই মেয়ে)।

বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলের দায় বের করতে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আহত, ভবন ও দোকান মালিক এবং আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।

তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ভবনে আগের হোটেলের রান্নাঘরের গ্যাসের লাইনটি সারেন্ডার করলেও পুরো ভবনে ছিল আবাসিক গ্যাস লাইন। বেজমেন্টে পার্কিংয়ের কথা থাকলে সেখানে বাংলাদেশ সেনেটারি নামে একটি কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রায় ১৮০০ স্কয়ার ফিটের এ আন্ডারগ্রাউন্ডটি পুরোটাই কাঁচে ঘেরা।

সেখানে ছিল না কোনো ভ্যান্টিলেশন ব্যবস্থা। বড় দুটি এসির মাধ্যমে ঠাণ্ডা রাখা হতো দোকানটি। সাততলা ভবনের কোথায় সুয়ারেজ সেপটিক ট্যাংক অবস্থিত সে বিষয়ে ভবনের মালিকরাও সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। ধারণা করা হয়, উত্তর পাশের ভবনের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের যে আড়াই থেকে তিন ফিট গলি আছে, সেখানে একইসঙ্গে দুটি ভবনের সেপটিক ট্যাংকি অবস্থিত।

ডিবির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকত। কোনো গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণের ঘটনাটিও ঘটতো না।

সাততলা ভবনের বেজমেন্টসহ তিনটি ফ্লোরের কমার্শিয়াল লোকজন, বাসা-বাড়ির লোকজনের পয়োবর্জ্য যেখানে জমা হয় দীর্ঘ সময় সেই জায়গা পরিষ্কার না করায় বায়োগ্যাস জমতে পারে। যা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে।

একসময় বেজমেন্টের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। যদিও পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য ফ্লোরের ডোমেস্টিক লাইন এখনও চলমান। ফলে এ লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণের হতে পারে পারে বলেও ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও তার উত্তরপাশে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনের মাঝখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে পয়োবর্জ্যর সেপটিক ট্যাংক, এসির আউটার রয়েছে। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পয়োবর্জ্যের বায়োগ্যাসের বিস্ফোরণেও এমনটি হতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির বেজম্যান্টে বড় একটি সেনেটারি দোকান, নিচ তলায় পাঁচটি দোকান, দোতলায় দুটি দোকান ছিল। এসব দোকানের অনেক কাঁচ ও পাওয়ারফুল এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলো ২০১০ সাল থেকে সার্ভিসিং করা হয়নি। এসি ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে।

সবশেষে ডিবির ভাষ্য, ভবনটি কোনো পরিত্যক্ত পাবলিক স্পেস নয়, এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। বিভিন্ন সার্বক্ষণিক স্যানিটারির ও সিসি ক্যামেরার সার্ভিলিয়েন্স ছিল। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখাও প্রায় অসম্ভব।

ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদ বলেন, বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট তদন্ত করছে। বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা প্রতিবেদন দিলে বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে এখনও পর্যন্ত বিস্ফোরক বা স্যাবোট্যাজের কোনো আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।

ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। এসবের ডিভিআর থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের ও দোকানের মালিকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্ফোরণের কারণ জানা চেষ্টা অব্যাহত আছে। সিদ্দিকবাজার এলাকায় কুইন সেনেটারি মার্কেট ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এটা রাজউকের দেখা উচিত ছিল- অনুমতি নিয়ে বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কিনা।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে কুইন সেনেটারি মার্কেটের বেজমেন্টে বিস্ফোরণের উৎসস্থল উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেজমেন্টের এই আন্ডারে গ্রাউন্ড স্পেসটি রাজউকের বিধান অনুসারে খোলামেলা থাকলে সেখানে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে নিরসন করা যেত। বায়োগ্যাসসহ অন্যান্য সমস্যারও সমাধান করা যেতো। বাড়ির মালিকরা টাকার লোভে আন্ডারগ্রাউন্ডকে এক সময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার ওপরেই সম্পূর্ণ এয়ারটাইট এসি করা নির্মাণ সামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন।

হারুন বলেন, দোকানের মালিক বিল্ডিং কোড না মেনে ভাড়া নিয়ে বেজমেন্টের ১ ইঞ্চি জায়গাকেও ফাঁকা না রেখে ডেকোরেশন করে দোকান বানিয়ে সেখানেই তার কর্মচারী ও ক্রেতা সাধারণের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। এতোগুলো প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ভবনের মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলারই ফল।

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, যারা ভবনটি থেকে ট্যাক্স আদায় করেন তাদের উচিত ছিল যাদের ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ট্যাক্স নিচ্ছেন, তারা বিল্ডিং কোড ফলো করছে কিনা সেটা জানা। ভবন ও দোকান মালিক, বাসিন্দাদের তো দায় ছিলই। রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনেরও উচিত ছিল ঠিকঠাক তদারকি করা।

ভয়াবহ এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও ডিবি প্রধান জানান। বিস্ফোরণে ২১ জনের প্রাণহানির ঘটনায় ভবনের মালিক ওয়াহিদুর রহমান, মতিউর রহমান ও ভবনের বেজমেন্টের স্যানিটারি ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব মিন্টুকে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আনা হয়। পরে তাদের আটক ও পরে অবহেলাজনিত একটি মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আদালতে তাদের বিরুদ্ধে রিমান্ড চাওয়া হবে। সেখানে তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও জানান ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০২৩
পিএম/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।