ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জাতীয় শিশু দিবস

শিশু বয়সেই বৈঠা হাতে দক্ষ তারা

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৩
শিশু বয়সেই বৈঠা হাতে দক্ষ তারা

বরগুনা (পাথরঘাটা): ১৩ বছরের শিশু রাকিবুল। এ বয়সে আর দশজন শিশুর মতোই তারও স্কুলে যাওয়ার কথা।

কিন্তু ১০ বছর থেকেই এই দুরন্ত শিশুকে দারিদ্র্যে কষাঘাতে পড়তে হয়। ১৪ বছরের সাব্বিরের একই অবস্থা। সাব্বির আর রাকিবুল এখন দক্ষ মাঝি।

শুধু সাব্বির, রাকিবুলই নয়, তাদের মতো একই অবস্থা বরগুনার উপকূলবর্তী এলাকার অনেক শিশুর। পারিবারিক অভাব-অনটন এসব শিশুর হাত থেকে বই নামিয়ে তুলে দিয়েছে বৈঠা ও মাছ শিকারের জাল। এরকম অবস্থা দেশের আরও অসংখ্য শিশুর। এমন শিশুদের সম্পর্কে হয় অনেক সভা-সমাবেশ। কিন্তু সাব্বির-রাকিবুলদের জীবনের কোনো পরিবর্তন আসে না।  

দিনে দিনে সাব্বির-রাকিবুলের মতো দক্ষ মাঝি হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের অনেক শিশু। তাদের কেউ অভাবের তাড়নায়, কেউ পরিবারের অবহেলা ও অসচেতনতায়, আবার কেউবা সামাজিক অবয়ের কারণে। জলবাযু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের শিশুরাও এমন ঝুঁকির পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এমনিতেই উপকূলের মানুষ দারিদ্রতার কারণে এসব কাজে ঝুঁকছে, পাশাপাশি শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ছে শিশু।  

বিশেষ করে করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, পরে বিদ্যালয় খুললেও আর ফেরেনি। জলবাযু পরিবর্তনের ফলে জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে এবং মাইগ্রেশন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝরে পড়ার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন বলেশ্বর নদে সারি সারি নৌকা। তবে এই নৌকাগুলো দেখলে যে কেউ বুঝবেন এগুলো মাছ ধরার নৌকা। এসব নৌকায় কিছু মানুষের ঘর-বাড়িও। পরিবারের কাছ থেকে বড়দের মতো শিশুরাও বিদায় নিয়ে বলেশ্বর নদে মাছ শিকারে আসে। এ নদীতেই থাকতে হয় দিনের পর দিন ঘর বাড়ির মতো। যে বয়সে মায়ের কোলে নিরাপদে থাকার কথা জীবিকার তাগিদে নদীতেই থাকতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। ঝড়-জলোচ্ছাস, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার মধ্যেও এসব শিশুরা নদীতে থাকে। ঘূর্ণিঝড় আসলে সৃষ্টিকর্তার ওপরই একমাত্র ভরসা। সব সময় নদীর উত্তাল মোহনায় বেশ ঝুঁকির মধ্যেই এসব শিশুরা বেড়ে ওঠে। অবহেলার মধ্যে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুরন্ত শৈশব কাটছে ওদের।

সরেজমিন বলেশ্বর নদ সংলগ্ন চরদুয়ানী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে ট্রলার ও নৌকা ঘাটে নোঙর করে আছে। অনেক নৌকা-ট্রলার ঘাটে নোঙরের চেষ্টা করছে। ঠিক এমন সময় দেখা মেলে সাব্বিরকে। কচি হাতে শক্ত বৈঠা নিয়ে দক্ষ মাঝি মতো ঘাটে নৌকা আনছে। ঘাটে মাছ বিক্রি করার জন্যই এসব ট্রলার নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন।

কথা হয় ১৩ বছরের শিশু সাব্বিরেরর সঙ্গে, চাচা আবুলের সঙ্গে ১০ দিন আগে পিরোজপুরের জিয়ানগর এলাকা থেকে পাথরঘাটা সংলগ্ন বলেশ্বর নদে মাছ শিকার করতে আসে। ১০ দিন মাছ শিকার করে মাত্র ৪ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করে। মাদরাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর পড়তে পারেনি। সেই থেকেই মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত সাব্বির।

কিভাবে পারিশ্রমিক পায় জানতে চাইলে শিশু সাব্বির বলে, এখানে দৈনিক ভিত্তিতে কোনো পারিশ্রমিক নেই। শেয়ারে ব্যবসার মতো। লাভ-লোকসান সমানে সমান। ৬ দিনের জন্য ৫ হাজার টাকার বাজার সদয় নিয়ে নদীতে মাছ ধরার জন্য বাড়ি থেকে আসি দাদার সঙ্গে। ১০ দিন থাকার পর মাত্র ৪ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছি। কাঙ্খিত মাছ না পাওয়ায় বাড়ি না গিয়ে চরদুয়ানী ঘাটে এসে আবার বাজার সদয় করে নদীতে মাছ ধরার জন্য থাকতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখিনি।

শিশু সাব্বিরের সঙ্গে কথা বলার সময়ই হঠাৎ চোখে পড়ে শিশু রাকিবুলের সঙ্গে। দাদা সেকান্দার হাওলাদার মাছ বিক্রির জন্য গেছেন চরদুয়ানী বাজারে। এদিকে ছোট নৌকায় বসে নিজে রান্না করছেন রাবিকুল। এ বয়সে রান্না তো দূরে থাক নদীতে এমন ঝুঁকির কাজ করার কথা নয়। পেটের দায়ে করতে হচ্ছে রাকিবুলের মতো অসংখ্য শিশুদের। কথা হয় রাকিবুলের সঙ্গে, গল্প বলেন দাদ্রিতা নিয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২ মাস লেখাপড়া করেছিল রাকিবুল। মহামারি করোনার ছোবল আর পরিবারের অভাব-অনটনে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার।

এদিকে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার পরিবারে অভাব-অনটন, স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া নানা কারণে দিন দিন বাড়ছে শিশু শ্রমিক ও জেলের সংখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত এমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। অন্যদের সঙ্গে পেশায় টিকে থাকতে এসব শিশুরা ১২ থেকে ১৪ বছরেই হয়ে উঠছে দক্ষ জেলে ও মাঝি।  

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর পাড়ে অনেক শিশু, কিশোর-কিশোরী মাছ শিকারে ব্যস্ত। কেউ কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে কোমড় পানিতে নেমে জাল টানছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আরডিএফ) তথ্যানুযায়ী, পাথরঘাটা উপজেলায় ২১০০ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে। তার মধ্যে মেয়ে ৭৯৫ ও ছেলে ১৩০৫। এসব ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখি করতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পাথরঘাটায় ৭০টি শিশুর শিখন কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে।

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আরডিএফ) যুগ্ম পরিচালক মো. এনামুল হক বলেন, করোনা কালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে, পরে বিদ্যালয় খুললেও আর ব্যাক করেনি। তালতলীতে একটা জরিপ আছে, সেখানে বাল্যবিবাহ ও গার্মেন্টস এ যাওয়ার প্রবণতা বেশি।  

তিনি আরও বলেন, জলবাযু পরিবর্তনের ফলে জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে এবং মাইগ্রেশন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝরে পড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন চিত্র পুরো জেলায়।

এ বিষয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘জাগো নারী’র  পরিচালক ডিউক ইবনে আমিন বলেন, শিশু শ্রমকে স্থানীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে, যে সকল শিশু আর্থিক কষ্টের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং একই সঙ্গে তাদের পরিবারকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।  

বেসরকারি সংস্থাগুলো স্কুল থেকে ঝরে পরা শিশুদের চিহ্নিত করে তাদের বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে আবার স্কুলমুখী করতে কাজ করতে পারে।

পাথরঘাটা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার টিএম শাহ আলম বলেন, শিশু শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ছে এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে ঝড়ে পড়ে, কিছু কিছু শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে মাদরাসাগামি হয়।  

তিনি আরও বলেন, ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখী করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি সকলের সমন্বয় এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন‌ করতে আমরা মা সমাবেশ করে থাকি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৩
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।