ঢাকা: নতুন আলোর সন্ধানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আহির ভৈরব সুরে সারেঙ্গি বাদনের মধ্য দিয়ে রাজধানীর রমনার বটমূলে শুরু হয়েছে ছায়ানটের বর্ষবরণ ১৪৩০–এর অনুষ্ঠান। প্রায় আট মিনিটের এই পরিবেশনার পর শুরু হয় গানের পালা।
বৈশাখের এই প্রথম সকালে শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) নতুন বছরকে এক কণ্ঠে বরণ করে নিচ্ছেন ছায়ানটের শতাধিক শিল্পী। সেখানে জীর্ণতা ঘুচিয়ে নতুনের আহ্বানে নববর্ষকে স্বাগত জানাচ্ছেন সব শ্রেণিপেশার মানুষ। বছরের প্রথম দিন নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন-আত্মজাগরণের সুরবাণী দিয়ে সাজানো হয়েছে ছায়ানটের এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
সম্মেলক গানের ফাঁকে ফাঁকে বিশিষ্ট শিল্পীদের একক কণ্ঠে থাকছে গান ও আবৃত্তি। এবারের গানগুলো সাজানো হয়েছে নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, আত্মবোধন আর জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। অনুষ্ঠানটি রমনা বটমূল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার সরাসরি সম্প্রচার করছে। এ ছাড়া ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলেও সরাসরি অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে।
সকাল সোয়া ৬টায় রাগ যন্ত্রবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। এদিন সকাল থেকে রমনার বটমূলে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের আসা শুরু হয়। এবার ১০টি সম্মিলিত গান, ১১টি একক গান, দুটি আবৃত্তি এবং সবশেষে জাতীয় সংগীতে সাজানো হয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এ অনুষ্ঠান।
সকালে এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই যাত্রা শুরু হয় নতুন আরেকটি বাংলা বছরের। সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি নতুন উদ্যমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয় পহেলা বৈশাখ।
রাজধানীতে ১৯৬৭ সালে প্রথম রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের সূর্যোদয়ের সময় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট। সেই অনুষ্ঠানই মূলত বাংলা নববর্ষ বরণের সাংস্কৃতিক উৎসবকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণা যুগিয়েছে।
সেই থেকে (১৯৬৭) পয়লা বৈশাখ উদযাপনের একটা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গও হয়ে উঠেছে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। এরপর কেবল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈরী পরিবেশের কারণে অনুষ্ঠান হতে পারেনি। ২০০১ সালে এ গানের অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা ভয়াবহ বোমা হামলা করলেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি। এর মধ্যে করোনার কারণে ২০২০–২১ সালে বর্ষবরণের এই আয়োজন সম্ভব হয়নি। দুই বছর পর গত বছর সাড়ম্বরে রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করে ছায়ানট।
এদিকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঘিরে রমনা উদ্যান ও এর আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া ছায়ানট কর্মীদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী, লাউড ওয়ার্কস ও থার্টিনথ হুসার্স ওপেন রোভার গ্রুপের নির্বাচিত সদস্যরা কাজ করছেন।
পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের মাধ্যমে বাঙালি যে বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে।
কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে রাজধানীসহ সারাদেশে চলছে নানা আয়োজন।
ছায়ানটের পাশাপাশি বর্ষবরণে থাকছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। সাধারণত নববর্ষে পান্তা-ইলিশসহ নানা রকম দেশি খাবারের আয়োজন থাকে। তবে এবার পবিত্র রমজানে দিনের বেলায় এসব খাবারের আয়োজন থাকছে না। আর সব কর্মসূচিও রমজানের মর্যাদা রক্ষা করে পালন করা হবে বলে আগেই জানিয়েছেন আয়োজকেরা।
রাজধানীর রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আসা ঋতু প্রামানিক বলেন, আগেও রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের উৎসবে এসেছি, এবারও এলাম। এটা যেন প্রাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিদ হাসান বলেন, এবারই প্রথমবার রমনায় এসেছি। বাংলা নববর্ষে সাম্প্রদায়িকতার যেই বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে সেটা যেন না ছাড়ায় এই প্রত্যাশা করি।
আগতরা জানান, বাংলায় নববর্ষ কেবল একটি বাৎসরিক আনুষ্ঠানিকতার ভেতরে সীমিত নয়। এর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। এই দিনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ একসঙ্গে একই অনুভবে একাত্ম হয়ে উৎসবে শামিল হন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৩
এইচএমএস/আরএইচ